কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম এসে এনআইডি ও পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। এ নিয়ে প্রশাসনে চলছে তোলপাড়। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে চমকপ্রদ তথ্য। এক্ষেত্রে ফয়াজ উল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গার বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্ট পাওয়ার তথ্য প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।
চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খান জানান, কক্সবাজার পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাহাড়তলীর ইসলামপুরে দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে বাস করছেন রোহিঙ্গা ফয়াজ উল্লাহ (৩৯)। সেখান থেকে রোববার রাতে তাকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে এনআইডি ও পাসপোর্ট পাওয়ার পুরো বর্ণনা দেন ফয়াজ উল্লাহ।
তিনি আরো জানান, কক্সবাজার পৌরসভার ইসলামপুরে ফয়াজ উল্লাহর একটি চায়ের দোকান আছে। এনআইডি কার্ড অনুযায়ী তার পিতার নাম মৃত লাল মিয়া, মায়ের নাম চেমন বাহার। তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুনও (৩৭) রোহিঙ্গা। প্রায় ২৫ বছর ধরে তারা সপরিবারে কক্সবাজার পৌর এলাকায় বসবাস করে আসছেন। অনেকেই জানতো না তারা রোহিঙ্গা। আর যারা জানতো, তারাও অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রকাশ করেনি।
ফয়াজ উল্লাহর ভাষ্যমতে, এনআইডি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলো তিনি বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে সংগ্রহ করেন। এরপর নির্ধারিত আবেদন ফরম পূরণ করে অনেকবার কক্সবাজার নির্বাচন অফিসে যান। কিন্তু অপর্যাপ্ত ডকুমেন্ট ও সন্দেহযুক্ত আবেদন হওয়ায় তাকে বারবার ফেরত দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এরপর ফন্দি আঁটেন, কোন পন্থায় এনআইডি পাওয়া যায়? বের করলেন একটি উপায়।
ফয়াজ উল্লাহর মতে, খোকন নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামে গিয়ে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এনআইডি’র জন্য ছবি তোলেন। যথারীতি নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
এছাড়া চট্টগ্রামে লাকি আক্তার নামের এক রোহিঙ্গা নারী শনাক্ত হয়। যার হাতে স্মার্টকার্ড পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ওই লাকি আক্তারের বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে আসে ফয়াজ উল্লাহসহ আরো বেশ কয়েকজনের নাম। যারা রোহিঙ্গা হওয়ার পরও নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে চূড়ান্ত হয়ে ঢুকে যায়।
টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদের স্মার্টকার্ড পাওয়ার পেছনের তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফয়াজ উল্লাহসহ আরো বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার তথ্য পাওয়া যায়।
মুনীর হোসাইন খান জানান, তথ্য জালিয়াতি করে বাংলাদেশের ভোটার হয়েছে এমন পাঁচ রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করে তাদের বিস্তারিত তথ্য নিতে কক্সবাজার নির্বাচন অফিসে পাঠায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়।
এরমধ্যে ছিলেন, ফয়াজ উল্লাহ (৩৯), ১ নম্বর ওয়ার্ডের কুতুবদিয়াপাড়ার নাজিরারটেকের বাসিন্দা মো. আইয়ুবের স্ত্রী নুরতাজ (৪১), সদরের পিএমখালী ৪ নং ওয়ার্ডের জুমছড়ির বাসিন্দা মৃত আবদুল হাকিমের ছেলে মোহাম্মদ নোমান (৪১), সদরের ঝিলংজা ৪ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম কোনারপাড়ার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ছেলে এহসান উল্লাহ (১৯)।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নির্দেশনার আলোকে রোহিঙ্গা নাগরিক ভোটার হওয়ার বিষয়ে সরজমিন তদন্তকালে ৫ জন রোহিঙ্গার বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। যার নম্বর যথাক্রমে ১৯৮০২২২২৪০৭০০০০২২, ১৯৯৮২২২২৪০৭০০০০২৩, ২০০১২২১২৪৪৭০০০০০১, ১৯৭৮২২২২৪০১০০০০১০, ১৯৭৮২২১২৪৭১০০০ ০২৩। অনলাইনে যাচাই করে দেখা যায়, তারা ২০১৯ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন ল্যাপটপ আইডি নং যথাক্রমে ০৩৫১-০০০০ এবং ৯৩১৮-০০০০ সদর উপজেলার ল্যাপটপ আইডি’র সঙ্গে যার মিল নেই। তাছাড়া তাদের ভোটার আবেদন ফরমের সঙ্গে উপজেলা থেকে সরবরাহকৃত ফরমেরও অমিল রয়েছে।
এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সদর থানা পুলিশের সহযোগিতায় ৫ জন রোহিঙ্গার মধ্য থেকে ফয়াজ উল্লাহকে আটক করা হয়। তাকে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা বিস্তারিত অনুসন্ধান করছেন।
তিনি আরও জানান, ফয়াজ উল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি স্বীকার করেছেন, ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি চট্টগ্রামে গিয়ে ভোটার হওয়ার জন্য ছবি তোলেন। বাংলাদেশি জাতীয়তা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তার আগে থেকেই সংগ্রহে ছিল। আর এই কাগজপত্র ও এনআইডি দিয়ে তিনি পাসপোর্টও সংগ্রহ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধির সহায়তায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জাতীয়তা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। তাছাড়া ভোটার হালনাগাদে তথ্য সংগ্রহে নিয়োজিত কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও এসব জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
অসাধু কিছু লোকের কারণে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র পৌঁছে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের হাতে। সেই সঙ্গে পেয়ে যাচ্ছে পাসপোর্ট।