পৃথিবীর সব সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে কিন্তু একমাত্র কিলিংমেশিন খ্যাত রাসেল ভাইপার বাংলা ভাষায় নাম চন্দ্রাবোড়া সাপের সে বৈশিষ্ট্য নেই। বিষধর সাপ হিসেবে পৃথিবীতে এর অবস্থান ৫ নম্বরে কিন্তু হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে তার অবস্থান প্রথমে।
এরা আক্রমণের ক্ষেত্রে এতই ক্ষিপ্র যে, ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ের ভেতরে কামড়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।
এ ধরনের একটি সাপ চাঁদপুর সদরের কোড়ালিয়ায় সোমবার দুপুরে একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। এ সময় অপু পাটোয়ারী নামের এক যুবক সাপটিকে নিজের সংরক্ষণে রাখেন। পরে তা উদ্ধার করেন উপজেলা সহকারী ভূমি কমিশনার ইমরান হোসাইন।
ইমরান হোসাইন বলেন, চন্দ্রাভোড়া মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে হস্তান্তর করা হয়েছে। এক মাস আগে একই প্রজাতির আরেকটি সাপকে পিটিয়ে মেরে ফেলে স্থানীয়রা।
সাপটি সম্পর্কে বিশ্ব তথ্যকোষ বলছে চন্দ্রাবোড়া অনেকটা অজগরের মত দেখতে হলেও এটি আসলে পৃথিবীর অন্যতম বিষধর সাপ চন্দ্রাবোড়া।” বিরল প্রজাতির এই সাপটি প্রচণ্ড বিষধর। ২০১৫ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে বিরল এই চন্দ্রাবোড়া সাপের কামড়ে আক্রান্ত ৩ জনের হাত পা কেটে ফেলেও তাদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ওইবার প্রায় ২৫ বছর পর এই বিরল প্রজাতির সাপটির দেখা মিলেছিল।
পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মারা যায়। এদের বিষদাঁত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে। চন্দ্রাবোড়ার বিষ হোমটক্সিন, যার কারণে কামড় দিলে মানুষের মাংস পচে যায়।
ভয়ংকর এই রাসেল ভাইপারের বাংলা নাম চন্দ্রবোড়া। তবে রাসেল ভাইপার নামেই বেশি পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii। এরা একেবারে সামনে থেকে মাথা উঁচু করে কামড় বসায়। এদের বিষের এত তিব্রতা যে, খুব কম রোগী বাঁচে। যে স্থানে কামড় দেয়; সে স্থানে পচন শুরু হয়। অনান্য সাপের বেলায় ৪৮ ঘণ্টা কেটে গেলে রোগীকে নিরাপদ ভাবা হয় কিন্তু চন্দ্রাবোড়ার বেলায় রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে মারা গেছে এমন রেকর্ডও আছে।
অন্যান্য সাপ শিকারের সময় শিকারকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে কিন্তু হিংস্র চন্দ্রাবোড়ার শিকারকে শুধু একা নয়, তার পুরো পরিবারসহ খেতে ভালোবাসে। তাই অন্যান্য সাপ যেমন একটি ইঁদুরকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে, চন্দ্রাবোড়া সে ক্ষেত্রে কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রচণ্ড বিষের যন্ত্রণায় ইঁদুর যখন তার গর্তের দিকে ছুটে চলে চন্দ্রাবোড়া তার পিছু পিছু গিয়ে সে গর্তে ঢুকে সব ইঁদুরকে খেয়ে ফেলে।
ধারণা ছিল, এরা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাঝে ২৫ বছর এদের দেখা মেলেনি কিন্তু প্রায় ২৫ বছর পর আবার দেখা মেলে ২০১২ সালে চাপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলে। সে বছর এর বিষে শুধু চাপাইনবাবগঞ্জে মারা যায় ১৫ জন। গবেষকদের ধারণা, ২৫ বছর বিলুপ্ত থাকার পরে বন্যার পানিতে ভেসে ভারত থেকে এই সাপ বাংলাদেশে এসেছে। কারণ পদ্মার তীরবর্তী এলাকায় এ সাপের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।
চন্দ্রাবোড়া বংশ বিস্তার করে খুব দ্রুত। অন্যান্য সাপ যেখানে ২০ থেকে ৪০টা ডিম দেয়, সেখানে একটি চন্দ্রাবোড়া ৮০টা পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে চন্দ্রাবোড়া।
পনেরো বছর যাবৎ ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফির পাশাপাশি বন্যাপ্রাণী নিয়ে গবেষণা করছেন আদনান আজাদ আসিফ। তিনি জানান, সাপুড়ে বা অন্য কোন মাধ্যম থেকে এই সাপকে দেখে এর ধারণা পাওয়া যাবে না। তার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘এ পর্যন্ত চারবার বুনো পরিবেশে এ সাপের মুখোমুখি হয়েছি। সামনা-সামনি না দেখলে বোঝা যাবে না এ সাপ কতটা ভয়ংকর এবং দুসাহসী।’
তিনি আরও জানান, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে এ সাপের আক্রমণ বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ওই এলাকার মাটি এবং চন্দ্রাবোড়ার গায়ের রং প্রায় এক। তাই অনেক সময় না দেখেই মানুষ কাছে চলে যায়। তাই এ সাপ দেখলে নিরাপদে সরে যাওয়াই উত্তম। তবে কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে এর থেকে বাঁচা সম্ভব-
আশেপাশে পরে থাকা পুরাতন গাছের নিচে খেয়াল না করে হাত না দেয়া, ধান কাটার সময় গামবুট ব্যবহার করা উচিত।
এছাড়া ধান কাটা শুরুর আগে হাড়ি-পাতিল বা অন্য কিছু দিয়ে প্রচণ্ড শব্দ করবেন, যেন সে ভয়ে পালিয়ে যায়। যেহেতু এরা খুবই হিংস্র, তাই যেসব এলাকায় বেশি দেখা যায়; সেসব এলাকায় সচেতনভাবে চলাফেরা করা। এ সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করলে সামনে থেকে সরে যাওয়া।
প্রতিবেদক- শরীফুল ইসলাম, ২০ আগস্ট ২০১৯
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur