সেদিন জার্মানিতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আশ্রয় দেন যিনি

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ঘটনার দিন থেকে পরবর্তী ৬ দিন জার্মানিতে তদানন্তীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর আশ্রয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দু’মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তখনও তারা জানতেন না তাদের পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। আর এ হত্যার ঘটনায় খন্দকার মোশতাক জড়িত তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হুমায়ুন চৌধুরীর স্ত্রী মাহজাবীন চৌধুরীর ঔ ছয় দিনের স্মৃতিচারণে জানা যায় ।

‘চাচা যেভাবে পারেন রাসেলকে এনে দেন।’রাসেলের খুব কষ্ট হচ্ছে । বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে। মা নিশ্চয়ই পাগল প্রায়। রাসেলের খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে না। থাকার নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে, ওর যত্ন হচ্ছে না । আমাদের কাছে রাসেলকে এনে দেন’। ১৫ আগস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরে জার্মানিতে যখন সে দেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় শেখ হাসিনা তখন চিৎকার করে কান্না করতে করতে এ কথাগুলো বলেন ।’

‘ততক্ষণে বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেই। দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এ খবর জানলেও তাদের দু’বোনের পরিবার বলতে- আপনজন বলতে পৃথিবীতে আর কেউ যে বেঁচে নেই- এটা তাদের কল্পনাতেই ছিল না। তাই তারা বাবার জন্যে কান্নাকাটি করলেও ছোট ভাই শেখ রাসেল—যে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িটি সারাদিন মাতিয়ে রাখতো আদরের সেই ছোট ভাইটির থাকা,খাওয়া ও যত্ন হচ্ছে না এটা ভেবেই ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলেন। ’

তাই মা,ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল ও তাদের স্ত্রীদের চেয়েও আগে শেখ রাসেলকে নিয়ে ভেবেছেন। কিন্তু ১৫ আগস্টের ঘাতকেরা যে শিশু রাসেলকেও হত্যা করে পৈশাচিকতার ইতিহাস রচনা করবেন এটা বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকা দু’বোন ভাবতেও পারেননি।

শুধু তাই নয়, আপন বলতে পৃথিবীতে তাদের কেউ যে আর বেঁচে নেই এ চিন্তা তাদের ছুঁতেই পারেনি অনেক দিন। জার্মানি থেকে ভারত যাওয়ার পরে জানতে পারেন পৃথিবীতে তাদের আর কেউ নেই।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত এ ৬ দিন জার্মানিতে যার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী মাহজাবীন চৌধুরী কথাগুলো বলছিলেন।

ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে ওঠে চাকরির মায়া ত্যাগ করে বিদেশে থাকা বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আশ্রয় দিয়েছেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও মাহজাবীন চৌধুরী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রদূত হিসাবে জার্মানিতে কর্মরত ছিলেন হুমায়ুন রশীদ। সঙ্গে থাকা স্ত্রী মাহজাবীন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত পিতৃহারা দু’কন্যার সেবাযত্ন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ব্যস্ত ছিলেন তাদের মানসিকভাবে সাহস ও শক্তি যোগানোতে।

সেখান থেকে দু’ বোন প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত সরকারের আশ্রয়ে যান। ধানমন্ডির পুরনো ২৭ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাসায় কথা বলেন মাহজাবীন চৌধুরী। এসময় সঙ্গে ছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে নোমান রশীদ চৌধুরী।

মাহজাবীন চৌধুরী বলেন, ‘১৫ আগস্টের ঘটনায় দু বোনের জিন্দেগি কষ্টের হয়ে গেল। ১৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের সবার একটাই চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধুর বেঁচে থাকা দু’কন্যার নিরাপত্তা নিয়ে। পরে এ দায়িত্ব নিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী।’

তিনি বলেন, ‘১৫ আগস্ট যখন ওরা আমার বাসায় আসে জার্মানিতে। ৩ তলার সেই বাসা থেকে গেইট ছিল কয়েক গজ দূরে। গেইট দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দু’ কন্যা যখন ঢুকছিলেন তখন আশ-পাশের সব শব্দ ভেদ করে শুধু চিৎকার করা কান্নার শব্দই পেতে থাকলাম। সে কী কান্না! এ কান্না আর থামেনি। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা রাত শুধু কান্নার শব্দই শুনেছি দু’কন্যার মুখে আর রাসেলকে ফিরে পাওয়ার আঁকুতি। বাসার ভেতরে ঢুকে যখন হুমায়ুন রশীদের সঙ্গে তাদের প্রথম দেখা হয় শেখ হাসিনা বলেন,‘চাচা গো আমাদের কাছে রাসেলকে এনে দাও।’ জবাবে রশীদ সাহেব বলেন,‘রাসেলকে এখানে আনার চেষ্টা করছি। তোমরা শান্ত হও।’

মাহজাবীন চৌধুরী বলেন,‘৬ দিন শেখ সাহেবের দু’কন্যা আমাদের বাসায় ছিল। এক মুহুর্তের জন্যে তাদের স্বাভাবিক দেখিনি। শুধু কান্না, হাউ মাউ, চিৎকার করে কান্না। আমাদের বাড়িটি ছিল তিন তলা। তৃতীয়তলায় ওদের দু ‘বোনের জন্যে দু’টি রুম ছিল। একটিতে ওয়াজেদ মিয়া শেখ হাসিনাকে নিয়ে থাকতেন । অপরটিতে শেখ হাসিনার সন্তান নিয়ে শেখ রেহানা থাকত। ওই দু’ রুমেই তারা থেকেছে। খাওয়া নাই,ঘুম নাই দু’বোনের। অনেক চেষ্টা করেছি তাদের মুখে খাওয়ার তুলে দেয়ার, ঘুম পাড়ানোর। কিন্তু কিছুতেই তাদের চিৎকার করা কান্না থামাতে পারতাম না। কোনোমতেই সান্ত্বনা দিয়ে তাদের দু’ বোনকে ভুলানো যেতো না।’

তিনি বলেন,‘মাত্র এক মাস আগে জার্মানিতে আমাদের বাসা বেড়িয়ে গেছে এ দু’ মেয়ে। হেসে-খেলে মজা করে গেছে। আর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে তাদের কেউ রাখবে, দায়িত্ব নেবে না। বেলজিয়াম হাই কমিশন কর্মরত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সানাউল হক ও মামুন নামে দু’ জন। বঙ্গবন্ধু যখন মারা যান বঙ্গবন্ধুর এ ঘনিষ্ঠরাই হুমায়ুন রশীদ সাহেবকে ফোন করে বলেন, ‘হুমায়ুন তুমি আমার বাসায় যে মেহমানগো পাঠিয়েছো তাদের ফেরত নিয়ে যাও।’ তিনি তখন বললেন,‘ঠিক আছে ফেরত পাঠিয়ে দিন। তবে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়ে পঠিয়ে দিয়েন।’

মাহজাবীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,‘বেলজিয়াম হাইকমিশন একটা গাড়ির ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দেয় নাই। তখন হুমায়ুন রশীদ বেলজিয়াম বর্ডারে একটি গাড়ি পাঠায় যা আমাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল। সেই গাড়িতে শেখ হাসিনার বাচ্চাদের জন্যে দুধ ও পানিসহ নাস্তা পাঠাই। ওই গাড়ি করে তারা জার্মানিতে আমাদের বাসায় আসে।’মাহজাবীন আরও বলেন,‘দু’ বোনকে কেউ রাখতে রাজি না হলেও আমি রাজি হয়েছি।’

তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন,‘জার্মানিতে বাংলাদেশি যারা থাকতেন তাদের মধ্য থেকে ২০-১৫ জনের একটি দল আমাদের বাসা ঘেরাও করে। তারা আমাদের বাসায় হামলা করে বোমা মারার হুমকিও দেয়। কারণ,এখানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি, তাই। আমি বাইরে এসে বললাম ‘এটা জার্মানি, বাংলাদেশ নয় । এখানে কার বাড়িতে হামলা করবে তোমরা?’ এরপর এ আশ্রয় দেয়ার অজুহাতে জিয়া সরকার ৬ মাসের জন্যে হুমায়ুনকে ওএসডি করল। শাস্তি স্বরূপ।

তিনি বলেন,‘শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যে ৬ দিন আমাদের বাসায় ছিল শুধু কান্না করত, আব্বা গো, আব্বা গো করে। তারা তখন পর্যন্ত ধারণা করছিল, শুধু তাদের বাবা নেই, অন্যরা বেঁচে আছেন। ৬ দিন পরে দু ‘বোন যখন আমাদের বাসা থেকে চলে যাচ্ছিলেন । তখন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী শেখ হাসিনার মাথায় হাত রেখে এ বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন যে ‘যাও মা তুমি একদিন বাংলাদেশের ইন্দিরা গান্ধী হবে।’ সেই তো হল। ছোট একটা মেয়ে কেমন পলিটিশিয়ান হয়েছে। আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছে। কেউ তাকে ক্ষতি করতে পারবে না। আমি অনেক দোয়া করি তাদের জন্যে।’

মাহজাবীন বলেন,‘১৮ না ১৯ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা শুনলেন বাংলাদেশের এ ক্যু’র সঙ্গে খোন্দকার মোশতাক আহমেদ জড়িত কথাটা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি।’

এ ঘটনার পর শেখ হাসিনা বারবার বললেন,‘আব্বা আমাদের সবসময় বলতেন কখনও কোনো বিপদে পড়লে তোমরা মোশতাক কাকাকে জানিও,যেও। সেই মোশতাক কাকাই আমাদের এতিম করলেন ।’(উৎস:বাংলা ট্রিবিউন)

বার্তা কক্ষ
১৫ আগস্ট ২০১৯
এজি