টেকনাফ সদরের শাপলা চত্বর থেকে মিনিট দশেক দূরত্বের নাজিরপাড়া। টেকনাফ পৌরসভার একেবারে শেষ প্রান্তে সদর ইউনিয়নের একটি গ্রাম। মূল সড়ক থেকে মাঠের পাশ দিয়ে কয়েক কদম হাঁটলেই মাঠের কোনায় এই গ্রামের জিয়াউর রহমানের আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি।
পেশায় ইয়াবা কারবারি জিয়া গত বছরের নভেম্বরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। তার বাড়িটিও অর্ধমৃত। বাড়ির প্রবেশপথের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে সামনের পুরো অংশ ভাঙাচোরা। দরজা-জানালা সবই ভেঙে পড়েছে। দেখে মনে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাড়ি।
জিয়ার বাবা মো. ইসলাম জানান, বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে পুলিশ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। জিয়ার বাড়ির মতোই তার পাশের বাড়িটিও গুঁড়িযে দেওয়া। বাড়িটির মালিক নুরুল হক ভুট্টো।
শুধু এ দুটি বাড়িই নয়, টেকনাফ উপজেলার অনেক গ্রামে পা রাখলেই এমন দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া অন্তত অর্ধশত বাড়ির দেখা মিলবে। প্রতিটিই আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির মালিকরা ইয়াবার জাঁদরেল ব্যবসায়ী। এসব বাড়ি এখন বিলকুল জনশূন্য।
গত কয়েক দিনে টেকনাফের নাজিরপাড়া, জালিয়ারপাড়া, মৌলভীপাড়া, ছোট হাবিরপাড়া, বড় হাবিরপাড়া, শিলবুনিয়া, ডেলপাড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা, শিকদারপাড়া, হোয়াখংসহ অনেক গ্রাম সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এসব গ্রামে গড়ে ওঠা ইয়াবা কারবারিদের অনেকের বাড়িঘর বিধ্বস্ত-বিচূর্ণ।
নাজিরপাড়া গ্রামের এক যুবক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টেকনাফের গ্রামে গঞ্জে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ধরতে পুলিশ তিন মাস প্রতি রাতে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে। ওই সময়ই এসব বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশি অভিযানে অতিষ্ঠ ইয়াবা ব্যবসায়ীরা প্রাণ বাঁচাতে গা ঢাকা দিয়েছে। ওই যুবক বলেন, বড় বড় এবং তালিকাভুক্ত কারবারিদের বাড়িতে অভিযানটা চলেছিল প্রবল বেগে, গুরুতর আঘাত হেনে।
তার বক্তব্যে সায় দেন আরেক যুবক। পেশায় স্কুলশিক্ষক ওই যুবক বলেন, অবিরাম এমন সাঁড়াশি অভিযান তারা এর আগে দেখেননি। গত অক্টোবরে টেকনাফের পুলিশ প্রশাসনে বড় পরিবর্তন আসার পর থেকে প্রায় তিন মাস ধরে অভিযানের মাত্রা ও ভয়াবহতা বেড়েছে কয়েক গুণ। এর আগে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও এতটা তৎপর ছিল না। নাজিরপাড়ার আরেক যুবক বললেন, সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলা যায়, টেকনাফের নতুন ওসি প্রদীপ কুমার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ইয়াবা কারবারিরা বাড়িঘর ছেড়ে পালায়।
ইয়াবা ব্যবসায়্যীদের এসব বাড়িঘর কীভাবে বা কারা ভেঙেছে জানতে চাইলে স্থানীয় লোকজন বলেন, রাতের বেলা কারা ভেঙেছে আমরা তা দেখিনি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির মালিকরা বলছেন, পুলিশ এমন করেছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পৌরসভা থেকে নাজিরপাড়া যাওয়ার পথে নাজিরপাড়া মূল সড়কের ওপর পলিথিন দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে একটি বাড়ি। পলিথিনের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, বাড়িটি ভেঙেচুরে একাকার। ডুপ্লেক্স এ বাড়ির মালিক সৈয়দ হোসেন। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বেয়াই।
শিলবুনিয়াপাড়ায় একটি আলিশান বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিক সাইফুল করিম। শূন্য থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া সাইফুল করিম হচ্ছেন টেকনাফের সর্বনাশের নাটের গুরু। তার হাত ধরেই ইয়াবা নামের মরণব্যাধি ঢুকেছিল সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে। কালক্রমে টেকনাফ হয়ে ওঠে ইয়াবার স্বর্গরাজ্য। জানা গেছে, মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হতেই দেশান্তরী হয়েছেন সাইফুল করিম।
আরও যেসব এলাকায় চূর্ণ-বিধ্বস্ত বাড়ির দেখা পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে টেকনাফ পৌর এলাকার জালিয়ারপাড়ার ইয়াবা ব্যবসায়ী মো. জুবায়ের, জিয়াউল ও মোজাম্মেল, মৌলভীপাড়ার আবদুর রহমান, তার ভাই একরাম এবং তাদের পিতা ফজল হাজী (যদিও তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ নেই। শুধু ছেলেদের কারণে তার বাড়িটি ভাঙনের শিকার হয়।), ডেলপাড়া গ্রামের শফিক, হোয়াখং গ্রামের জুনায়েদ আলী শিকদার, টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও লেদা গ্রামের নুরুল হুদা মেম্বার ও বাবুল মেম্বারের বাড়ি।
ইয়াবা কারবারিদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়াকে সমর্থন করছেন স্থানীয় লোকজনও। মৌলভীপাড়া গ্রামের এক ব্যক্তি জানালেন, ইয়াবা ব্যবসার টাকায় যারা এমন শাহেনশাহি বাড়িঘর বানিয়েছে সেসব বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই উচিত। সরকারের উচিত এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা।
শুধু বাড়িঘরই নয়, মাছ ধরার যেসব ট্রলার ব্যবহার করে ইয়াবা কারবারিরা মিয়ানমার থেকে সাগরপথে ইয়াবার চালান নিয়ে আসত সেসব ট্রলারের অনেক পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সংখ্যা কমপক্ষে ১৬টি হবে।
স্থানীয় প্রশাসনের সূত্রগুলো বলছেন, দুর্বৃত্তদের মনে চরম ভীতি তৈরি করতে প্রশাসন নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে যাতে ওরা টেকনাফে আর কখনো ইয়াবার কারবার চালানোর সাহস না পায়। এসব বাড়িঘর ভাঙার বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, পুলিশ কারও বাড়িঘর ভাঙেনি। কেউ থানায় এসে অভিযোগও করেনি। কারা ভেঙেছে সে বিষয়েও তিনি অবগত নন। কেউ যদি থানায় অভিযোগ করে তাহলে পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
তিনি বলেন, ইয়াবা কারবারিদের অর্থবিত্তের দাপটের সামনে এখানকার সাধারণ মানুষ একেবারেই অসহায় এবং তটস্থ। ইয়াবাবিরোধী অভিযান শুরুর ফলে হয়তো এলাকার ক্ষুব্ধ লোকজন কারবারিদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়ে থাকতে পারে। তিনি আরও জানান, তিনি শুনেছেন মাছ ধরার বেশ কিছু ট্রলার যেগুলো দিয়ে ইয়াবার চালান আসে সেগুলো স্থানীয় লোকজন রাতের আঁধারে পুড়িয়ে দিয়েছে।
এবার সাপুড়ে সেজে ইয়াবা পাচার : সাপুড়ে সেজে সাপের বাক্সে করে ইয়াবা পাচারের সময় আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। ২৪ জানুয়ারি সকালে নগরীর কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্যারটেক এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আবুল হোসেন ঢাকা জেলার সাভারের কাঞ্চনপুর এলাকার আনু মিয়ার ছেলে।
কর্ণফুলী থানার ওসি আলমগীর মাহমুদ বলেন, সাপ রাখার বাক্সে করে আবুল হোসেন টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালানটি ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ওসি বলেন, আবুল হোসেনকে আটকের পর বাক্সে সাপের চামড়া, তন্ত্র-মন্ত্রের হাড়, তেলসহ বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায়। সে নিজেকে সাপুড়ে দাবি করে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানাতে থাকে। একপর্যায়ে সাপের বাক্সের তলা কেটে ৫ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। (বাংলাদেশ প্রতিদিন)
২৬ জানুয়ারি, ২০১৯