রহমান রহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে-
নাম তার আব্দুল ওয়াহ্হাব। আমেরিকান এক মুসলমান। কয়েকদিন পূর্বে বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলেছেন এক ষোড়শী যুবতীকে। যুবতীর নাম রাইহানা। যুবতী বেশ সুন্দরী। অনিন্দ্য সুন্দরী। ওর বাইরের রূপটা যে কোনো পুরুষকে মুগ্ধ করলেও ভিতরটা তার ঘোর অন্ধকারে ঢাকা। কারণ ইসলামের আলো এখনো তার অন্তর জগতে প্রবেশ করেনি। কালেমায়ে শাহদাত পড়ে মুসলমান হয়নি। ধর্মে ছিল সে খৃস্টান।
আর এ অবস্থায়ই নববধূ হয়ে চলে আসে জনাব আব্দুল ওয়াহ্হাবের স্ত্রী হয়ে।
রাইহানা ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেবকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মোকাবেলা করতে হয়েছে মারাত্মক পরিস্থিতির। পাঠকবৃন্দ! চলুন, জনাব আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেবের মুখ থেকেই তাদের কাহিনীটা হৃদয়ঙ্গম করি। সেই সাথে নিজেরা শিক্ষা গ্রহণ করে তদানুযায়ী নিজেদের জীবনকে ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করি।
আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেব বলেন, রাইহানাকে বিয়ে করার সময় আমি ছিলাম নামে মুসলমান। ইসলামী বিধি-বিধান পালনের কোনো গুরুত্ব আমার মধ্যে ছিল না। তাই সেগুলো রীতিমত পালনও করতাম না। এমনকি কোনো খৃস্টান মেয়ের সাথে কোনো মুসলমান ছেলের বিয়ে সহীহ হয় না একথাটিও আমার জানা ছিল না। রাইহানার অবস্থাও ছিল আমার মতো। সেও তার ধর্মের প্রতি আন্তরিক ছিল না। বরং বলা যায়, ধর্ম কিংবা ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের ব্যাপারে তার কোনো মনোযোগই ছিল না। আমি অবশ্য মাঝে মধ্যে মসজিদে যেতাম। নামাজ পড়তাম। কিন্তু সে কখনো চার্চে যেতো না।
কিছুদিন পর আমাদের একটা সন্তান হলো। তখন আমি সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় বিভোর হলাম। ভাবলাম, আমি ও আমার স্ত্রী যদি একই ধর্মের অনুসারী না হতে পারি, তবে সন্তান বড় হয়ে কোন্ ধর্মের অনুসারী হবে। তাই আমি রাইহানাকে মসজিদে যাওয়ার দাওয়াত দিলাম। কিন্তু আমার দাওয়াত সে স্পষ্ট ভাষায় কেবল অস্বীকারই করল না, উল্টো চার্চে যেতে শুরু করল। এমনকি এটি একটি অলিখিত নিয়মই হয়ে গেল যে, তাকে আমি যখনই মসজিদে যাওয়ার কথা বলি তখনই সে চার্চে ছুটে যায়।
এবার আমার বোধদোয় হলো। আমি ভাবলাম, আমি মুসলমান, আমার স্ত্রী খৃস্টান। হায়, এ আমাদের কেমন জিন্দেগী? মুসলমানের ঘরে খৃস্টান বউ! তাছাড়া এতদিন তো অবস্থাটা এমন ছিল যে, সে চার্চে যেত না। কিন্তু এখন? এখন তো সে চার্চেও যায়!
আমি বিষয়টি নিয়ে খুব ফিকির করলাম। তাকে মুসলমান বানানোর জন্য কী কৌশল অবলম্বন করা যায়, এ নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলাম। অবশেষে তাকে এই প্রস্তাব দিলাম যে, চলো এক রবিবারে আমরা উভয়ে চার্চে যাবো, আর আরেক রবিবারে যাব মসজিদে। সে খানিকটা চিন্তা করে আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল। এই প্রস্তাব দ্বারা আমার উদ্দেশ্য ছিল, আমি চাছিলাম যে কোনোভাবে ইসলামের পরিচয় তার সামনে প্রকাশিত হোক। সে ইসলামের কাছে আসুক।
আমি যখন আমার স্ত্রীকে মুসলমান বানানোর ফিকির করছিলাম তখন আমার মাঝেও আত্ম সচেতনতা সৃষ্টি হলো। আমি মনে মনে নিজকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, আমি কেমন ঈমানদার যে, মুসলমান হয়েও ইসলামী বিধি-বিধান ঠিকমত পালন করি না? ইসলামের রঙে রঙিন হই না? তাছাড়া আমি নিজে ইসলাম পালন না করে, আরেকজনকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তা কতটুকুই বা কার্যকর হবে? না, আমাকে আর এভাবে চললে হবে না। আমাকে পুরোপুরি মুসলমান হতে হবে। আমলদার হতে হবে। ইসলামের যাবতীয় বিধান একশ ভাগ পালন করতে হবে। তখন হয়তো আমার স্ত্রীকে আর ইসলাম গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করতে হবে না। কারণ সে যখন তার স্বামীর মধ্যে ইসলামের অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করবে, অতি সহজে তখন ইসলামের প্রকৃতরূপ তার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে। ফলে তখন সে নিজেই ইসলামের প্রতি আগ্রহী হবে এবং আল্লাহ চাহেত ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয়ও নিবে।
যে কথা সে কাজ। সেদিন থেকে আমি আমার জীবন বদলাতে শুরু করলাম। আলেম-উলামাদের সান্নিধ্যে যেতে লাগলাম। একান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতে লাগলাম, ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান। প্রত্যেক কথা ও কাজে অনুসরণ করতে লাগলাম, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি সুন্নত। ঘরে বাইরে সকল ক্ষেত্রে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে লাগলাম। মোট কথা ইসলামী আচার-আচরণে রাঙিয়ে তুললাম আমার জীবনের প্রতিটি অঙ্গন।
আমি যখন ধর্মের প্রতিটি বিধান একান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম, তখন আমি মনের মধ্যে এমন এক প্রশান্তি অনুভব করলাম, যা কেবল অনুভব করা যায়, অন্যকে বলে বুঝানো যায় না। আর সে প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল রাইহানার কোমল হৃদয়কেও। দেখা গেল, কিছুদিনের মধ্যেই সে ইসলামী আচার-আচরণ ও সভ্যতার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে। দুর্বল হয়ে পড়ে ইসলামের প্রতি। তাছাড়া ঘরে ইসলামী পরিবেশ, আর মসজিদ থেকে ইসলাম সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা শ্রবন এ দুই বস্তু ইসলামের প্রতি তার দুর্বলতা ও আগ্রহকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তুলে। ফলে বেশিদিন আমাকে অপো করতে হয়নি। ইসলামের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে একদিন সে কালিমায়ে শাহাদত পড়ে মুসলমান যায়। আলহামদুলিল্লাহ।
আরো খুশি ও শুকরিয়ার ব্যাপার হলো, ইসলাম গ্রহণের পর রাইহানা আশ্চর্য রকমভাবে বদলে যায়। মুসলমান হয়ে ইসলামকে সে গ্রহণ করে প্রাণখুলে, পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও ভালোবাসার সাথে। সে তার জীবনের প্রতিটি কাজকে ইসলামের রঙে রঙিন করে তুলতে প্রয়াসী হয়ে ওঠে। পর্দা করতে শুরু করে। তাও আবার অসম্পূর্ণ পর্দা নয়। অর্থাৎ মুখ কিংবা চোখ বের করা ‘ফ্যাশনী পর্দা’ নয়। রাইহানা প্রায়ই বলে, মুসলমানের ঘরে জন্ম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম নারীরা কেন পর্দা করে না? আর করলেও কেন পুরোপুরি করে না? কেন তারা ইসলামী কায়দায় মাথা ঢাকে না?। কেন তারা শরীরটা ঢেকে সৌন্দর্যের উৎস ‘মুখখানা’ খোলা রাখে? তাদের কি কোনো অনুভূতি নেই? তারা কি বুঝে না যে, মুখ কিংবা চোখ খোলা রেখে পর্দা করলে পর্দার বিধান সম্পূর্ণরূপে পালিত হয় না? তবে কি তারা আল্লাহকে ভয় করে না? তাদের কি চিন্তা নেই যে, উত্তমরূপে পর্দার বিধান পালন না করলে মৃত্যুর পর কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে তাদেরকে? এমনকি দুনিয়াতেও সম্মুখীন হতে পারে নানাবিধ পেরেশানীর? তাছাড়া ইসলামী পোষাক তো নারীর ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে তোলে। তার মর্যাদাকে বিকশিত করে। আহা! ওরা না বুঝেই অন্যদের রঙ চড়াতে চাচ্ছে নিজেদের গায়ে!
ইসলামের প্রতি রাইহানার বিশ্বাস ছিল পরম শাণিত। ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামী শিক্ষার প্রতি তার ঝোঁক অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। সে এখন অন্য ধর্মের কোনো বই-পুস্তক পড়ে না। বরং ইসলাম ধর্ম বিষয়ক বই-পুস্তক এনে দেওয়ার জন্য আমাকে সে বারবার অনুরোধ জানাতে থাকে। আমিও সানন্দে দেশের বিভিন্ন নামকরা লাইব্রেরীগুলো খোঁজে ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে নামকরা লেখকদের লেখা বই-পুস্তক কিনে ওর হাতে তুলে দেই। এসব বই হাতে পেয়ে রাইহানা যেমন আনন্দিত হয়, তেমনি দারুণ পুলকিত হই আমিও। কারণ, আমি তো এমনটিই চাচ্ছিলাম। বড় কথা হলো, ইসলাম সম্পর্কে রাইহানা যা-ই জানতো, যা-ই শিখতো তার উপরই সে আমল শুরু করে দিত। আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতো আপনার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। আপনার পরশ পেয়েই আমি এ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছি। আল্লাহ পাক আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
সন্তানের ব্যাপারে রাইহানার বক্তব্য ছিল অসম্ভব স্বচ্ছ। সে তার সন্তানকে ইসলামী স্কুলেই পড়াবে এ যেন তার কঠিন প্রতিজ্ঞা। তার কথা হলো ইসলামী শিক্ষা ছাড়া কেউ পরিপূর্ণ মুসলমান হতে পারে না। সে প্রায়ই বলত, পার্থিব শিায় কোনো ঘাটতি থাকলে সেটা পরবর্তিকালে পুষিয়ে নেওয়া যায় কিন্তু ধর্মীয় শিায় কোনো ঘাটতি থাকলে সেটা আর পুষিয়ে নেওয়া যায় না।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেব ও রাইহানার দাম্পত্য জীবন আজ পরম আনন্দের, পরম সুখের। ইসলামের স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় তারা লাভ করে অপূর্ব প্রশান্তি। ইসলাম ধর্ম জানা ও মানার মধ্যে যে এত শান্তি আছে, এত সুখ আছে তা যদি তারা আরো আগে জানতো, আরো আগে বুঝতো, তবে শান্তি-সুখের এই সুন্দরতম জীবনকে আরো আগেই তারা গ্রহণ করত।
হে আল্লাহ! ওরা যে কথাটি বুঝতে পেরেছিল, দাম্পত্য জীবনের কয়েকটি বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর সে কথাটি আমাদেরকে বুঝার এবং সে অনুপাতে জীবন যাপন করার তাওফীক দাও আজই এখন থেকেই। আমীন।
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫