‘নারীর ভোটাধিকার’ বলতে নির্বাচনে নারীর ভোটপ্রদানের অধিকারকে বোঝায়। যার ইংরেজি: ডWomen’s suffrageev women’s right to vote। মূলত ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাতিসংঘ নারীদের ভোটাধিকারকে উৎসাহিত করতে থাকে। ১৯৭১ সালে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ নামক সনদটিতে জাতিসংঘের ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে নারীর ভোটাধিকারকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশে সাড়ে ১০ কোটি ভোটারের অর্ধেকই নারী। তাই যে কোনো নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে নারীদের ভোটকে একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে ধরা হয়। কারণ এদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে ভোটকেন্দ্রে পুরুষ ভোটারের তুলনায় নারী ভোটারই উপস্থিত বেশি থাকে। কেবলমাত্র ভোটের মাঠে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকলেই নারী ভোটাররা স্বর্তষ্ফুতভাবে ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যান।
নিকট অতিতের মতো আগামী ৩০ ডিসম্বের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলেও নারী ভোটাররা বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে পর্যবেক্ষরা মনে করছেন। ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নারী ভোটারদের গুরুত্ব দিয়ে নানান হিসাব-নিকাশ করছে রাজনীতিক দল ও প্রার্থীরা। তারা নির্বাচনে নামার আগে নারী ভোটের অংক সর্বাগ্রে মাথায় রাখেন। তাই সংসদ নির্বাচনে নারী ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করণে ভোটকেন্দ্রের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সর্বাগ্রে আবশ্যিক হয়ে দেখা দিয়েছে।
কোনো কারণে যদি ভোট কেন্দ্রে নারী ভোটারদের উপস্থিতি কম দেখা দেয় তবে কোনো কোনো প্রার্থীর জন্য সেটি হতাশার কারণ হয়ে দেখা দিবে। কারণ ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে নির্বাচনী সহিংষ্ণতা ততই বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে এবারের নির্বাচনে নারী ভোটারদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে বোদ্ধামহল ধারণা করেছে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইড (নির্বাচন কমিশন কর্তৃক চূড়ান্ত হিসাব) সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ২৫ লাখ ১২ হাজার ১০৫ জন। আর নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ২৭৬ জন। অর্থাৎ নারী-পুরুষ ভোটারদের মধ্যে সংখ্যার ব্যবধান ৮ লাখ ৮১ হাজার ৮২৯ জন। আর পুরুষ ও নারী ভোটারের অনুপাত ৫০.৪২ : ৪৯.৫৮। গত ৩১ জানুয়ারি কমিশন সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের চূড়ান্ত এই তালিকায় এ তথ্য প্রকাশ করে।
ভোটারদের হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে আরও দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট নারী-পুরুষ ভোটারের অনুপাত কাছাকাছি হলেও সংখ্যায় আবারে দেশের ১৮টি জেলায় নারী ভোটাররা পুরুষের তুলনায় এগিয়ে আছেন। বাকি ৪৬ জেলায় পুরুষ ভোটার বেশি। নারী ভোটারের সংখ্যা যেসব জেলায় বেশি সেগুলো হচ্ছে—বরগুনা, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, গাইবান্ধা, হবিগঞ্জ, জয়পুরহাট, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, মানিকগঞ্জ, মেহেরপুর, নওগাঁ, নড়াইল, পটুয়াখালী, রাজশাহী, রংপুর, শেরপুর ও টাঙ্গাইল।
২০০৮-এ প্রথমবারের মতো ছবিসহ তৈরিকৃত ভোটার তালিকায় পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি ছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল মোট আট কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার তিনজন। এর মধ্যে নারী ছিল চার কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৮২০ জন এবং পুরুষ ভোটার তিন কোটি ৯৭ লাখ ৮৭ হাজার ৬৩৬ জন। ২০১৩ সালের ভোটার তালিকার হালনাগাদে পুরুষের তুলনায় নারী ভোটার কম নিবন্ধিত হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৭৬ ভোটারের মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল চার কোটি ৫৮ লাখ ৪২ হাজার ৬৯৮ ও পুরুষের সংখ্যা ছিল চার কোটি ৬১ লাখ ২২ হাজার ৪৬৯ জন।
এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও যাতে উলে¬খযোগ্য সংখ্যক নারী নিরাপদ পরিবেশে ভোট দিতে পারেন সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। ভোট প্রয়োগে নারীর মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
‘নারীর নিরাপদ অংশগ্রহণ ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের সচেতনতামূলক’ আলোচনা সভায় কবিতা খানম বলেন, দেশের অর্ধেক ভোটার নারী। কর্মক্ষেত্র ও রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তা কাঙ্খিত পর্যায়ে এখনও পৌঁছেনি। কিন্তু নারীদের বাদ দিয়ে কোনোভাবেই গণতন্ত্র সুসংহত করা সম্ভব নয়।
তাই জনপ্রতিনিধি হিসেবে নারীদের নির্বাচিত করার পথকে আরও প্রসারিত করতে হবে। এজন্য নির্বাচন কমিশন কাজ করছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রার্থীদের প্রতি উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, আমরা চাই, নারীর মতামতে কেউ প্রভাবিত করবেন না। ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের মতামতকে নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত করতে সহযোগিতা করবেন। নারীনা যাতে নির্বিঘেœ কেন্দ্রে যেতে পারেন সেজন্য ভোটের দিন সুষ্ঠু পরিবেশ দিন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এবারে নারী ভোটারের মধ্যে শিক্ষিতের হার অনেক বেড়েছে। তাদের অনেকেই এবার জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, শিক্ষিত ও বয়সে তরুণ এসব নারীরা ভোটাররা ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে তুলনামূলক সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকেই বেছে নেবেন। বিষয়টি মাথায় রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও নারী ভোটারদের নির্বাচনে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন। নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর উন্নয়নের বিষয়টি পেতে যাচ্ছে বিশেষ গুরুত্ব। অবশ্য ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নারী ভোটারদের গুরুত্ব দিয়েই তাদের প্রাক-নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন।
লেখক পরিচিতি: সাবিত্রী রাণী ঘোষ
সাংবাদিক ও লেখক।
তথ্যঋণ: নির্বাচন কমিশন ওয়েবসাইট