তারামন বিবির। জন্ম ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে। বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি।
১৯৭১ সালে তারামন বিবি ১১নং সেক্টরে নিজ গ্রামে ছিলেন। তখন ১১নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।
যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। পরবর্তীতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান।
একদিন দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় তারামন ও তার সহযোদ্ধারা জানতে পারেন পাকবাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে। তারামন তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন এবং তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন।
এরপর তারামন অনেক সম্মুখযুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নেন। একাত্তরের রণাঙ্গনে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়ায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৯৪। গেজেটে নাম মোছাম্মৎ তারামন বেগম।
‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত তারামন বিবিকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি দে প্রথম তার সন্ধান পান। এ কাজে বিমল কান্তিকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী।
১৯৭১ সালে ১৩ থেকে ১৪ বছরের এক কিশোরী, যাকে কিনা মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করা ও ফুট-ফরমায়েশ খাটার জন্য ক্যাম্পে আনা হয়েছিল, তখন কে জানত একদিন এই কিশোরীই হয়ে উঠবে বাংলাদেশের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ‘প্রতীক মুক্তিযোদ্ধা’।
তারামন বিবির এই বিরল সম্মান অতি সহজেই আসেনি। তার কর্ম, তার সাহস এবং দেশের প্রতি ওই কচি বয়সেই দেশপ্রেমের যে উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন তারই উপযুক্ত পুরস্কার তিনি পেয়েছেন।
‘তারামন বিবি’ এমনই এক প্রতীকী নাম যে, বাংলাদেশের অন্যান্য মহীয়সী নারীর নামের পাশে আজ তার নামটিও উচ্চারিত হয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর এ মহীয়সী নারী দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
সম্মুখ সমরে পুরুষের পাশাপাশি যে ক’জন নারী মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন তারামন বিবি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য এবং সবচেয়ে কম বয়সী মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের যে গ্রাম্যকিশোরী রান্নার সময় নরম হাতের আঙুলে ভাত টিপে পরখ করে দেখত সিদ্ধ হয়েছে কিনা, দেশের প্রয়োজনে সেই কিশোরীই একদিন শক্তহাতে শত্র“ মোকাবেলায় সেই আঙুলেই মারণাস্ত্রের ট্রিগার চেপে ধরেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে তার এই অবদানের জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার এই শুভ সংবাদটি সেদিন তারামন বিবির কাছে কেউ পৌঁছাল না। ফলে যা হওয়ার তাই হল।
তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞাতই রয়ে গেলেন এ খেতাবপ্রাপ্তির বিষয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পরও কেউ তার কোনো খবর রাখেনি। তিনি রয়ে গেলেন লোকচক্ষুর সম্পূর্ণ আড়ালে।
ময়মনসিংহ জেলার আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিমল কান্তি দে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি একদিন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দেখতে গিয়ে তারামন বিবির নাম দেখতে পান।
ইতিপূর্বে তিনি তারামন বিবি নামে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত কোনো নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা শোনেননি বা কোনো মিডিয়াতেও দেখেননি। এরপর তিনি তারামন বিবি সম্পর্কে আরও আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং তার খোঁজখবর নিতে শুরু করেন।
অবশেষে ১৯৯৫ সালে কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুরে তারামন বিবিকে আবিষ্কার করেন। এ ব্যাপারে অবশ্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান আলী ও রাজিবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী তাকে সাহায্য করেন।
তারামন বিবিকে খুঁজে পাওয়ার পর চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। সে সময় তাকে নিয়ে পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি শুরু হয়ে যায়। নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে।
অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবির হাতে বীরপ্রতীক খেতাবের স্মারক তুলে দেন।
তারামন বিবিকে নিয়ে আনিসুল হক একটি বই লিখেছেন ‘বীর প্রতীকের খোঁজে’। আনিসুল হক রচিত ‘করিমন বেওয়া’ নামক একটি বাংলা নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল তারামন বিবি।
তারামন বিবির স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন তিনি।
শনিবার (১ ডিসেম্বর) রাত দেড়টার দিকে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছর।
তিনি দীর্ঘদিন থেকে দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস, ডায়েবেটিস আর শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছিলেন। শীত শুরু হওয়ায় তার ঠাণ্ডা লেগে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। যে কারণে গত কয়েকদিন ধরে নিজে নিজে হাঁটা চলা ভালোভাবে করতে পারছিলেন না শীত শুরু হওয়ায় তার ঠাণ্ডা লেগে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। গত কয়েকদিন ধরে তিনি নিজে নিজে হাঁটা চলা ভালোভাবে করতে পারছিলেন না বলে জানান স্বজনরা।
এরআগে গত ৯ নভেম্বর তাকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ময়মনসিংহ সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কদিন পরে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে নিজ বাড়িতে ফিরে যান।
শনিবার (১ ডিসেম্বর) দুপুর ২টায় তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বার্তা কক্ষ
৬ ডিসেম্বর, ২০১৮
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur