জাতীয় মাছ ইলিশ আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। অনাদিকাল থেকেই আমাদের জাতীয় অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও আমিষ জাতীয় খাদ্য সরবরাহে এ মাছ অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে।
দেশের মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান ১২% এবং বার্ষিক উৎপাদন ৪ লাখ ৯৭ হাজার মে.টন (২০১৬-১৭)। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২০ হাজার কোটি টাকারও উর্দ্ধে। জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান ১%।
বিগত ক’দশকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে অর্থ্যাৎ নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, পরিবেশ বিপর্যয়, নির্বিচারে জাটকা নিধন ও অধিকমাত্রায় ডিমওয়ালা ইলিশ আহরণ ইত্যাদিতে ইলিশের উৎপাদন দ্রূত হ্রাস পাচ্ছিল।
এ মাছের উৎপাদন সহনশীল পর্যায়ে বজায় রাখতে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা কৌশল যেমন-জাটকা সংরক্ষণ, সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ আহরণ নিষিদ্ধকরণ, অভয়াশ্রম স্থাপন ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা হচেছ। প্রতিষ্ঠিত অভয়াশ্রমসমূহের জাটকা এবং প্রজননক্ষম ইলিশ ধরা নিষেধাজ্ঞা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলাফল, নতূন অভয়াশ্রম চিহ্নিতকরণ ও প্রতিষ্ঠা, বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রভাব নির্ণয় এবং ইলিশের আবাস্থল নদী মোহনার ইকোলজির ওপর বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর হতে গবেষণা পরিচালিত হয়ে আসছে।
অভয়াশ্রম হচেছ মাছের নিরাপদ আবাস্থল যেখানে মাছ তাদের জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে নিরাপদে বসবাস, প্রজনন এবং খাদ্য গ্রহণ করে বড় হয়। মাছের নিরাপদ আবাস্থল সংরক্ষণের জন্য কোনো জলাভূমি বা জলাভূমির অংশ বিশেষে কোনো নির্দ্দিষ্ট সময় বা সারা বছর মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে।
অভয়াশ্রম ঘোষণার প্রধান উদ্দেশ্য হচেছ মাছকে আহরণ হতে রক্ষা করে অবাধ প্রজনন এবং বিচরণের সুযোগ সৃষ্টি করে সহনশীল উৎপাদন বাজায় রাখাসহ উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। ছোট আকারের ইলিশ মাছ অনধিক ২৫ সে.মি.আকার পর্যস্ত আমাদের দেশে প্রচলিতভাবে জাটকা বলা হয়। জাটকার অধিক আহরণের কারণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২৫ সে.মি.পর্যন্ত আকারের জাটকা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট,নদী কেন্দ্রের গবেষণায় দেখা যায় , ১৯৮৬ সাল থেকে ইলিশ মাছের‘ রিক্রুটমেন্ট ওভার ফিশিং’ অর্থ্যাৎ নির্বিচারে মা ইলিশ ধরা এবং ‘গ্রোথ ওভার ফিশিং ’অর্থ্যাৎ নির্বিচারে জাটকা ধরার ফলে এ মাছের নতুন প্রজন্মের পুন:সংযোজন প্রক্রিয়া বা প্রবেশন ব্যাহত হচ্ছিল।
এ অবস্থায় থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে জাটকা ইলিশের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র নিম্ম মেঘনা, তেঁতুলিয়া ও আন্ধারমানিক নদীতে ২০০৫ সালে ৪ টি অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১০-২০১১ সালে শরিয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত নিম্ম পদ্মা নদীর ২০ কি.মি.এলাকায় ৫ম অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়।
অভয়াশ্রমের মাধ্যমে জাটকা সংরক্ষণের ফলে দেশে ইলিশ মাছের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশ উৎপাদনে অভয়াশ্রমের প্রভাব ও জাটকার প্রাচুর্য নির্ণয়ের জন্য নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর হতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে গবেষণা পরিচালনা করা হচেছ। এ প্রেক্ষাপটে বরিশালের হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ অঞ্চলের নদীতে একটি নতূূন অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সফলভাবে জাটকা রক্ষা ও সামগ্রিক ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি কার্যক্রম গতিশীল রাখা সহজতর হবে।
মেঘনা,তেঁতুলিয়া ও আন্ধারমানিক নদীতে প্রথমে ৪ টি ইলিশ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট
দেশের অভ্যন্তরীণ ১ শ’ টি নদ-নদীতে জাটকা পাওয়া যায়। প্রতি বছর নভেম্বর হতে জুন মাস পর্যন্ত জাটকা বিচরণের মৌসুম হলেও মার্চ এবং এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণে (৬০-৭০%) জাটকা ধরা পড়ে। তাই নভেম্বর হতে জুন মাস পর্যন্ত জাটকা ধরা বন্ধ করা প্রয়োজন হলেও জেলেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বিকল্প কর্মসংস্থান ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে জাটকা প্রাচুর্যতার সর্বোচ্চ সময়কাল মার্চ-এপ্রিল ও নভেম্বর-জানুয়ারি মাসে জাটকা ধরা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়।
ফলে অভয়াশ্রম ঘোষণার প্রয়োজন পড়ে। জাটকা প্রাচুর্যের ভিত্তিতে গবেষণার মাধ্যমে ৫ টি অভয়াশ্রম চিহ্নিত করা হয় এবং সার্বিকভাবে জাটকা রক্ষা তথা ইলিশের সামগ্রিক উপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৫ সালে গেজেট নোটিশের মাধ্যমে প্রথমত : ৪টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এগুলো হলে : ১. চাঁদপুর জেলার ষাটনল হতে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার (মেঘনা নদীর নি¤œ অববাহিকার ১ শ’ কি.মি.এলাকা), ২. ভোলা জেলার মদনপুর-চর ইলিশা হতে চর পিয়াল (মেঘনা নদীর শাহ্বাজপুর শাখার ৯০ কি.মি. এলাকা), ৩. ভোলা জেলার ভেদুরিয়া হতে পটুয়াখালী জেলার চর রুস্তম (তেতুঁলিয়া নদীর প্রায় ১ শ’ কি.মি.এলাকা), ৪. পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কি.মি. এলাকা এবং পরবর্তীতে (৫) শরিয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত নিম্ম পদ্মা নদীর ২০ কি. মি.এলাকা।
যা ২০১০-২০১১ সালে শরিয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত তারাবুনিয়া-বেপারী পাড়া অঞ্চলে নি¤œ পদ্মা নদীর ২০ কি.মি.এলাকাকে ৫ম অভয়াশ্রম হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তথা মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময় ৫ টি অভয়াশ্রমের ৪ টিতে প্রতি বছর মার্চ হতে এপ্রিল জাটকা ধরা তথা সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয় । শুধুমাত্র আন্ধারমানিক নদীর অভয়াশ্রমটিতে প্রতি বছর নভেম্বর হতে জানুয়ারি পর্যন্ত জাটকাসহ সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। এতে নদীর জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হয়।
নিম্ম পদ্মা নদীতে ৫ম ইলিশ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বামগই), নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর হতে পরিচালিত ২০০৮ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে ১ শ’ মিটার দৈর্ঘ্যের এক তন্ত বিশিষ্ট পরীক্ষামূলক আদর্শ ফাঁস জাল ব্যবহার করে পরীক্ষামূলকভাবে জাটকা আহরণের মাধ্যমে পদ্মা এবং মেঘনা নদীর বিভিন্ন অংশের জাটকার তুলনামূলক প্রাচুর্য নির্ণয় করা হয়।
প্রতি এক ঘন্টার হলিং -এ নিম্ম পদ্মা নদীর অংশে ধৃত জাটকার সংখ্যা ২-৩১, গড়ে পদ্মা নদীতে ৮টি এবং একই সময়ে মেঘনা নদীতে ২৮টি জাটকা পাওয়া যায়। পদ্মা অববাহিকার নিম্নাংশে শরিয়তপুর জেলার তারাবুনিয়া অঞ্চলে সর্বোচ্চ ৩১ টি এবং সুরেশ্বর এলাকায় ২টি জাটকা পাওয়া যায়। জাটকার প্রাচুর্যতা কম থাকার কারণে,পানির গুণাগুণ ও মাছের খাদ্যকণা তথা প্ল্যাংকটনের পরিমাণ ইত্যাদি বিবেচনা করে সুরেশ্বর অঞ্চলকে অভয়াশ্রম ঘোষণার প্রস্তাব করা হয় নি বরং তারাবুনিয়া-বেপারী পাড়া অঞ্চলকে অভয়াশ্রম ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়।
তাছাড়া উল্লেখিত অঞ্চলে জাটকার সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও নিম্ম পদ্মা নদী, মেঘনা নদীর মোহনপুর অঞ্চল সংলগ্ন হওয়ায় উক্ত এলাকার জেলে, ব্যবসায়ীসহ সচেতন জনগণ নিম্ম পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে একটি অভয়াশ্রম ঘোষণার জন্যে দীর্ঘদিন ধরে জোরালোভাবে দাবি জানিয়ে আসছে।
পদ্মা নদীর এ অংশে ইলিশ মাছ তথা জাটকার বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় রেখে পানির গুণাগুণ ও মাছের খাদ্যকণা তথা প্ল্যাংকটনের পরিমাণ ইত্যাদির আধিক্য বিশ্লেষণ করে শরিয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত নিম্ম পদ্মা নদীর ২০ কি.মি.এলাকা নিয়ে ৫ম অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয় । যাতে উক্ত এলাকায় ভবিষ্যতে জাটকার প্রাচুর্য আরও বৃদ্ধি, ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং পদ্মা নদী ইলিশ সমৃদ্ধ হতে সহায়ক হয়।
এভাবে ২০১০-২০১১ সালে ৫ম অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতি বছরের মার্চ হতে এপ্রিল মাসে অভয়াশ্রমটিতে জাটকা ধরা তথা সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়।
৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম চিহ্নিতকরণের পদ্ধতি ও কৌশল
ইলিশ উৎপাদনে অভয়াশ্রম স্থাপনের জন্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর হতে অব্যাহত গবেষণা পরিচালিত হয়ে আসছে। গবেষণায় প্রধানত: (ক) নদীতে জাটকার (লার্ভি ও জাটকা) প্রাচুর্যতা পর্যবেক্ষণ, (খ) নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষা এবং (গ) নদীর পানির প্ল্যাকংটন (খাদ্যকণা ) পর্যবেক্ষণ করা হয়।
নদীতে জাটকার প্রাচুর্যতা পর্যবেক্ষণ
জাটকার প্রাচুর্যতা নির্ণয়ের জন্য ইলিশ গবেষণা দল কর্তৃক ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এপ্রিল মাসে সরেজমিন পরিদর্শন,নিয়মিত নমুনা বা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ইনস্টিটিউটের নদী কেন্দ্র চাঁদপুর কর্তৃক উদ্ভাবিত দু’ধরনের পরীক্ষামূলক জাল যেমন: নাইলনের সূক্ষ্ম সুতার আদর্শ বেহুন্দী জাল এবং একশ’ মিটার দৈর্ঘ্যের এক তন্ত বিশিষ্ট আদর্শ ফাঁস জাল দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এক ঘন্টার হলিং (ঐধঁষরহম)-এ নির্ধারিত একক প্রচেষ্টায় ধৃত (ঈচটঊ) জাটকার পরিমাণকে একক (কেজি) ধরে হিসাব নিরূপণ করা হয়।
নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষা
ইলিশ গবেষণা দল কর্তৃক পানির গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য নিয়মিত নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় । পানির গুণগুত মান পরীক্ষার জন্য নদীর পানি সংলগ্ন বাতাসের তাপমাত্রা (০প), নদীর পানির তাপমাত্রা (০প), নদীর পানির স্ব”ছতা (সে.মি.), দ্রবীভূত অক্সিজেন (মি.গ্রা./লিটার), মুক্ত কার্বন-ডাই অ´াইড (মি.গ্রা./লিটার), পিএইচ, হার্ডনেস (মি.গ্রা./লিটার), টোটাল অ্যালকালিনিটি (মি.গ্রা./লিটার), কন্ডাক্টটিভিটি (ক্রঝ/সে.মি.) ও এমোনিয়া (মি.গ্রা./লিটার) পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ঘোষণাযোগ্য নতুন এলাকার নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা হয় এবং প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত এলাকা মৎস্যকূল ও অন্যান্য জলজ জীবের জন্য নিরাপদ স্বাস্থকর পরিবেশ বজায় রাখতে নির্দেশক হিসাবে কাজ করে ।
নদীর পানির প্ল্যাংকটন (খাদ্যকণা) পর্যবেক্ষণ
ইলিশ গবেষণা দল কর্তৃক পানিতে বিরাজমান প্রাকৃতিক খাবারের অবস্থ পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়মিত নদীর পানির প্ল্যাকংটন (খাদ্যকণা) এর দু’ধরনের খাদ্যকণা (১) ফাইটোপ্ল্যাকংটন (উদ্ভিজ্জ খাদ্যকণা) এবং (২) জুপ্ল্যাকংটন (প্রাণিজ খাদ্যকণা) নমুনা ৫০ মাইক্রন প্ল্যাকংটন নেট দিয়ে সংগ্রহ করা হয় । সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ঘোষণাযোগ্য নতুন এলাকার নদীর পানিতে মাছের খাবারের প্রাচুর্যতা নির্ণয় করা হয়। যা মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য নিশ্চয়তার নির্দেশক হিসাবে কাজ করে।
৬ষ্ঠ অভয়াশ্রমের স্থান চিহ্নিতকরণ ও মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময় নির্ধারণে ফলাফল বিশ্লেষণ
ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত গবেষণায় নদীতে জাটকার প্রাচুর্যতা পর্যবেক্ষণ, নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষা ও নদীর পানির প্ল্যাকংটন (খাদ্যকণা) তথা মাছের খাদ্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে জাটকার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া যায়। পরবর্তীতে অভয়াশ্রম স্থাপনের জন্যে স্থান নির্বাচন, জিপিএস মান চিহ্নিতকরণ ও মাছ ধরার নিষিদ্ধকালীন সময় নির্ধারণ করা হয়।
নদীতে জাটকার প্রাচুর্যতা পর্যবেক্ষণ
বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার নাছাকাটি পয়েন্ট, হরিনাথপুর পয়েন্ট ও ধুলখোলা পয়েন্ট (হিজলা উপজেলার ধর্মগঞ্জ এর নয়াভাঙ্গানী নদী এলাকা) এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ভাষানচর পয়েন্ট (মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার লতা নদী এলাকা) এবং বরিশাল সদর উপজেলার জুনাহার পয়েন্ট (কালাবদর ও আড়িয়াল খাঁ নদী এলাকা) এর ৮২ কি.মি. অঞ্চল সমূহে জাটকার প্রাচুর্যতা নির্ণয়ের জন্যে ইলিশ গবেষণা দল কর্তৃক মার্চ-এপ্রিল ও অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সরেজমিন পরিদর্শন, নিয়মিত নমুনা বা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষামূলক আদর্শ (সূক্ষ নাইলন সুতার তৈরি বেহুন্দী) জাল দিয়ে ১-৩.৫ সে. মি. দৈর্ঘ্যসীমার জাটকা পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ২.৫-৩.৫ সে. মি. মেস দৈর্ঘ্যরে সুতা বা নাইলণ এর পরীক্ষামূলক আদর্শ ফাঁস জাল দিয়ে ১০-২৫ সে. মি. দৈর্ঘ্য সীমার জাটকার ক্ষেত্রে এক ঘন্টার হলিংয়ে ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত গড়ে যথাক্রমে ২.০-৩.১০ কেজি (ঈচটঊ) জাটকা পাওয়া যায়। প্রাপ্ত ফলাফল উক্ত অঞ্চলকে জাটকা সমৃদ্ধ বলে প্রমাণ করে।
নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষা
ইলিশ গবেষণা দল কর্তৃক পানির গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য নিয়মিত নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ২০১০-১১ সাল থেকে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করা হয়। ২০১৪-১৫ সালে নদীর পানি সংলগ্ন বাতাসের তাপমাত্রা (১৭.৫- ৩০.৫ ডি.সে.), নদীর পানির তাপমাত্রা (১৭- ৩০ ডি.সে), নদীর পানির স্বচছতা (২২-৪০ সে.মি), দ্রব্য অক্সিজেন (৫.৬ – ৬.৮ মি.গ্রা./লিটার), মুক্ত কার্বন-ডাই অ´াইড (৮.৫- ১১.৭ মি.গ্রা./লিটার), পিএইচ (৭.৫-৮.৫), হার্ডনেস (৫০- ৯৮ মি.গ্রা./লিটার), টোটাল অ্যালকালিনিটি (৩২-৭৮ মি.গ্রা./লিটার), কন্ডাক্টিভিটি (১৮৫-২২০ ক্রঝ/সে.মি.) ও এমোনিয়া (০.০ মি.গ্রা./লিটার) পরীক্ষা করা হয় । প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পরীক্ষিত সকল প্যারামিটারের মান নদীর জীববৈচিত্র্যের জন্যে অনুকূল রয়েছে।
নদীর পানির প্ল্যাকংটন পর্যবেক্ষণ
ইলিশ গবেষণা দল কর্তৃক পানিতে বিরাজমান প্রাকৃতিক খাবারের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্যে নিয়মিত নদীর পানির প্ল্যাকংটন (খাদ্যকণা) ৫০ মি.মাইক্রন প্ল্যাকংটন নেট দিয়ে সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। দু’ ধরনের খাদ্যকণা (ক) ফাইটোপ্ল্যাকংটন (উদ্ভিজ্জ খাদ্যকণা) ও (খ) জুপ্ল্যাকংটন (প্রাণিজ খাদ্যকণা) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে ফাইটোপ্ল্যাকংটন (উদ্ভিজ্জ খাদ্যকণা) এর আধিক্য বেশি। যা মাছের খাদ্য প্রাচুর্যতা নিশ্চিত করে।
উৎপাদিত জাটকার পরিমাণ ও অভয়াশ্রম বাস্তবায়নের উপকারিতা
বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ’র মেঘনা ও মেঘনার শাখানদী এবং বরিশাল সদরের কালাবদর নদীসহ ৮২ কি.মি. নদী এলাকায় ইলিশ বা জাটকার নতুন ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম বাস্তবায়ন হলে বছরে প্রায় ৪ হাজার ৩ শ’ কোটি অতিরিক্ত জাটকা ইলিশ জনতায় যুক্ত হবে বলে আশা করা যায়।
অভয়াশ্রম বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে শুধুমাত্র ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচেছ তা-ই নয়, অনান্য মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচেছ, অনান্য মাছও ডিম ছাড়ার ও বড় হওয়ার সুযোগ পাচেছ । সে কারণে সামগ্রিকভাবে জীব বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হচেছ। বর্তমানে কম-বেশি সারা বছর বির্স্তীর্ণ অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের ইলিশ পাওয়া যাচেছ। অভয়াশ্রম বাস্তবায়নের কারণে ইলিশের ধারাবাহিক উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত আছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাটকা আহরণকারী মৎস্যজীবিদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম-পরিকল্পনা অনুসরণ করে বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি ১৭ টি জেলার ৮৫ টি উপজেলায় মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে ।
এখানে জাটকা আহরণে বিরত ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬ শ’ ৭৩ জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি হারে ৪ মাসের জন্য ৩৮.১৮৮ মে.টন চাল প্রদান করা হয় । তাছাড়া অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মৎস্যজীবিদের অগ্রাধিকার প্রদান পূর্বক ন্যূনতম ১ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে যা দিয়ে মৎস্যজীবীরা আয় বর্ধনমূলক কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে।
বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন, ভ্যান-রিক্সা, ঠেলাগাড়ি চালানো, ফল ও সবজির ব্যবসা, সেলাই মেশিন, জাল বুনন ইত্যাদি আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়। বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে গৃহীত এ সব পদক্ষেপ জাটকা সংরক্ষণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
তাছাড়া, মৎস্য অধিদপ্তর এবং ওয়ার্ল্ডফিশ (বিডি) এর যৌথ উদ্যেগে ইকোফিশ (বিডি) প্রকল্পের মধ্যমে উপকূলীয় ৯টি জেলার ২৯ টি উপজেলায় এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ২ শ’৩৬ জন সুফলভোগীকে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে । যা জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ।
সীমানা চিহ্নিতকরণ ও জাটকা ধরার নিষিদ্ধকালীন সময় নির্ধারণ
বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার নাছাকাটি পয়েন্ট, হরিনাথপুর পয়েন্ট ও ধুলখোলা পয়েন্ট (হিজলা উপজেলার ধর্মগঞ্জ বা গজারিয়া এবং নয়াভাঙ্গানী নদী এলাকা) এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ভাষানচর পয়েন্ট (মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার লতা নদী এলাকা) এবং বরিশাল সদর উপজেলার জুনাহার পয়েন্ট (কালাবদর ও আড়িয়াল খাঁ নদী এলাকা) এর ৮২ কি.মি. অঞ্চল সমূহে জাটকার প্রাচুর্যতা প্রাপ্তির ভিত্তিতে উক্ত এলাকায় নতুন ঘোষণাযোগ্য অভয়াশ্রমের জিপিএস পয়েন্ট ও সীমানা নির্ধারণ করে ইলিশ বা জাটকার নতুন ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম ঘোষণার জন্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বরাবর প্রস্তাব করা হয়।
বরিশালের হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জে প্রস্তাবিত ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রমের সীমানা যেমন উত্তর-পৃর্বে বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার নাছাকাটি পয়েন্ট (নয়াভাঙ্গানী নদী), উত্তর-পশ্চিমে বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার হরিণাথপুর পয়েন্ট (নয়াভাঙ্গানী নদী), দক্ষিণ-পূর্বে বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার ধুলখোলা পয়েন্ট (ধর্মগঞ্জ বা গজারিয়া নদী), দক্ষিণ-পশ্চিমে বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ভাষানচর-জুনাহার পয়েন্ট (লতা, কালাবদর, আঁড়িয়াল খাঁ নদী) অঞ্চলকে নির্ধারণ করা হয় ও মার্চ-এপ্রিল মাসে সর্বাধিক জাটকা মাছ প্রাপ্তির কারণে মার্চ-এপ্রিল মাসকে জাটকা ধরার নিষিদ্ধকালীন সময় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়।
২০১৭ সালে সম্মিলিতভাবে মৎস্য অধিদপ্তর, বিএফআরআই ও ওয়ার্ল্ডফিশ প্রতিনিধি মিলে নি¤œলিখিতরূপে সংশোধিত আকারে জিএসআই ম্যাপিং চূড়ান্ত করা হয় এবং গৃহীত হয়। যা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
‘বরিশালের সদর উপজেলার কালাবদর নদীর হবিনগর থেকে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার বামনার চর পয়েন্ট পর্যন্ত ১৩.৭ কি.মি দীর্ঘ (১৩.১৪ বর্গ কিমি), মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার গজারিয় নদীর বামনার চর পয়েন্ট থেকে হিজলা উপজেলার হিজলা লঞ্চ ঘাট পয়েন্ট পর্যন্ত ৮.৮১ কিমি দীর্ঘ (৩০.২৭ বর্গ কি.মি) এলাকা এবং হিজলা উপজেলার হিজলা লঞ্চঘাট পয়েন্ট থেকে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার মেঘনা নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম জাঙ্গালিয়া পয়েন্ট (জুনাহার পয়েন্ট) পর্যন্ত ৫৯.৫১ কি.মি.দীর্ঘ,২শ’৭৪ বর্গ কি.মি এলাকায় বিস্তৃত, ৮২ কি.মি দীর্ঘ,৩ শ’১৮ বর্গ কি.মি নদী এলাকা ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে অনুমোদিত হয়।’
প্রসঙ্গত, ইলিশ উৎপাদনে ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম স্থাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট,নদীকেন্দ্র চাঁদপুর বিগত ৫ বছর যাবৎ ধারাবাহিকভাবে গবেষণা পরিচালনা করেছে। বরিশাল সদর ও বরিশালের হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা অঞ্চলে মেঘনার শাখা নদীগুলিতে জাটকার প্রাচুর্যতা পরিলক্ষিত হয়।
নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষায় দেখা যায় ,সকল গুণাবলীর মাত্রা নদীর জীববৈচিত্র্যের জন্যে অনুকূল। একই অঞ্চলে প্ল্যাকংটনের (খাদ্যকণা) আধিক্য লক্ষ্য করা যায় যা মাছের খাদ্য প্রাচুর্যতা নিশ্চিত করে। গবেষণালব্ধ সামগ্রিক ফলাফলের ভিত্তিতে জাটকার প্রাচুর্যতা,নদীর পানির গুণাগুণ এবং নদীর পানির প্ল্যাকংটন (খাদ্যকণা) ইত্যাদি সহ সার্বিক বিবেচনায় জাটকা বা ইলিশের জন্য উক্ত অঞ্চলের পরিবেশ অনুকূল রয়েছে একথা নিশ্চিত হওয়া যায়।
ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অধিক মাত্রায় ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা আহরণ হতে রক্ষা করে মাছের অবাধ প্রজনন এবং বিচরণের সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে সহনশীল উৎপাদন বাজায় রাখাসহ উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অপরিহার্য। এ অঞ্চলটি অভয়াশ্রম আকারে বাস্তবায়ন হলে বছরে গড়ে ৪ হাজার
৩ শ’ কোটি অতিরিক্ত জাটকা ইলিশ জনতায় যুক্ত হবে বলে ধারণা করা যায়।
বরিশাল অঞ্চলের নদ-নদীসমুহ আরো ইলিশ সমৃদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে উক্ত অভয়াশ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। এমনকি ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেও এ অঞ্চলটি (৮২ কি.মি.) অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণার যোগ্য ছিল।
আরো উল্লেখ্য,ধারাবাহিকভাবে একই অঞ্চলে কমপক্ষে ৩ বছর উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যাবলী অনুকূল বিবেচিত হওয়ায় ইতোপূর্বে ঘোষিত (৫টি ইলিশ অভয়াশ্রম) অঞ্চলসমূহকে অভয়াশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
এ প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলকে ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা ও স্থাপনের নির্মিত্তে জোর সুপারিশ করা হয় এবং সেটি বাস্তবায়নের পর্যায়ে যায়। এক একটি অভয়াশ্রম হচেছ এক একটি রূপালী ইলিশ উৎপাদনের কারখানা । প্রয়োজন শুধু ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন। তাহলেই বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ সম্পদ উন্নয়নের ও সহনশীল উৎপাদনের গতিধারা বজায় থাকবে এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক পরিচিতি: ড. মো.আনিছুর রহমান, ইলিশ গবেষক,মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র চাঁদপুর।
প্রকাশ-১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮্ । সোমবার
সম্পাদনায় : আবদুল গনি