রাজধানীর কদমতলীর মদিনাবাগ। সেখানকার একটি বাসা থেকে ইমরান নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ইমরানের দেহ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলন্ত ছিল। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির সময়ই পুলিশের সন্দেহ হয়।
ইমরানের বৃদ্ধা মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবারই দাবি- ছেলেটি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ফাঁসিতে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
কিন্তু পুলিশের চোখ আটকে যায় ইমরানের মৃতদেহের কিছু অংশে। সেখানে রক্তাক্ত কাটা দাগ। এটা কি স্রেফ আত্মহত্যা নাকি খুন? পুলিশের মনে এমন প্রশ্ন। সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ইমরানের অসম প্রেমের করুণ কাহিনী। কদমতলী থানা পুলিশ জানায়, ফেসবুকের আইডি ও মেসেঞ্জার থেকে কিছু তথ্য উদঘাটন করা হয়। এরপর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সব কাহিনী।
মৃত্যুর আগে ইমরান তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ওপেন করে রেখেছিল। মোবাইলের অপর পাশে ছিল ইমরানের ভালোবাসার পাত্রী নুসরাত বেগম (ছদ্মনাম)। ভালোবাসার পাত্রীকে দেখানোর জন্যই ছিল তার যত আয়োজন। মৃত্যুর আগে ভিডিও কল দিয়ে ইমরান তার মৃত্যুর সব আয়োজন নুসরাতকে দেখায়। তার প্রস্তুতি ছিল ওড়নার ফাঁসের গিঁটটা ঠিকমতো হলো কিনা, ওড়নার ওপরের অংশ ফ্যানের হুকের সঙ্গে ঠিকমতো বাঁধা হলো কিনা এবং ঘরের দরজাটা ঠিকমতো লাগানো হলো কিনা ইত্যাদি। ইমরানের ধারণা ছিল, এসব আয়োজন দেখে নিশ্চয় বিয়েতে রাজি হবে নুসরাত।
এর আগে সিগারেট আর মশার জ্বলন্ত কয়েল নিজের শরীরে ছ্যাঁকা দিয়েও দেখিয়েছে। নুসরাতের মন গলেনি। ব্লেড দিয়ে একের পর এক পোঁচ দিয়েও দেখিয়েছে। কাজ হয়নি। সর্বশেষ সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যার আগ মুহূর্তে হয়তো নুসরাত বলবে, আমি তোমাকে বিয়ে করব। এমনই বিশ্বাস নিয়ে ঘরের ভিতর ফাঁসির মঞ্চ সাজানো শেষে খাটের ওপর দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকে সরাসরি নুসরাতের ইনবক্সে ভিডিও কল দেয় ইমরান। এর আগেও সে অনেকবার নুসরাতকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছে। উদ্দেশ্য বিয়েতে রাজি করানো।
ভিডিও কলে ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রথমে সে নুসরাতকে ফাঁসির মঞ্চসহ পুরো ঘরটা দেখায়। বহুবার এসব দেখে অভ্যস্ত নুসরাত ভিডিও কলে এসব না করতে সাধ্যমতো বোঝায় ইমরানকে। কিন্তু ইমরানের একটিই কথা-অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হোক তা দেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এভাবে কথোপকথনের একপর্যায়ে মোবাইলের চার্জ শেষ হওয়ায় অফ লাইনে চলে যায় নুসরাত। কিন্তু ফোন অন করে আত্মহত্যার পথে এগিয়ে যায় ইমরান।
পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ইমরানের আত্মহত্যার ভিডিওটি আমরা উদ্ধার করেছি। একজন সুস্থ মানুষ ভিডিওটি দেখতে পারবে না। একটা মেয়ের জন্য কীভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় ছেলেটি। ওড়না দিয়ে ফাঁস তৈরি করে তাতে মাথা ঢুকিয়ে ঝুলে পড়ে ইমরান। ফাঁসের টানে গলা ধরে এলে হাত থেকে পড়ে যায় ফোন। কিছুক্ষণ মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করার পর এক সময় নিথর হয়ে যায় ইমরানের ঝুলন্ত দেহ।
তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ইমরানের মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেই মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় নুসরাতের অজানা থেকে যায় অনেক কিছু। পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা ইমরানের ফেসবুক খুলে ইমরান সেজে নুসরাতের সঙ্গে চ্যাটিংয়ে অংশ নেন। তখন নুসরাত আবারও জানায়, সামাজিকতা ও পারিবারিক কারণে ইমরানকে তার বিয়ে করা সম্ভব নয়। পুলিশ তখন নিশ্চিত হয় ইমরানের প্রেমের বিষয়টি।
তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, ২০১৬ সালের আগস্টে ফেসবুকে পরিচয় ইমরান ও নুসরাতের। এরপর ইনবক্সে কথা চালাচালি। এরপর প্রেম, ভালোবাসা। কয়েক দিনের মধ্যেই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এক রেস্টুরেন্টে দুজনের সাক্ষাৎ। দেখা-সাক্ষাতের দু-চার দিনের মধ্যেই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী নুসরাত বুঝে যায় ইমরান খুব বেশি লেখাপড়া জানে না। এমনকি মাধ্যমিকের গণ্ডিও পাড়ি দিতে পারেনি। কিন্তু বেসামাল প্রেমে পাগল নাছোড়বান্দা ইমরান শিক্ষার চেয়ে তার ভালোবাসাকেই বড় করে দেখতে চায়।
নুসরাতকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে সে। নুসরাত তাতে রাজি হয় না। তার বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা। বাবার সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করেই নুসরাত ইমরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু মানতে চায় না ইমরান। পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, অসম প্রেমের এই কাহিনী চলে কিছুদিন। বেসামাল অবস্থায় চলতে চলতে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকলেও অবুঝ প্রাণ দুটিকে কাউন্সেলিং করার জন্য এগিয়ে আসেনি কেউ। অসময়ে ঝরে যায় ইমরানের প্রাণ। তাদের শুরুটা হয়েছিল ফেসবুকে, শেষ হলো করুণ মৃত্যুতে।
কদমতলী থানার মদিনাবাগ এলাকায় ইমরানের বাবার বাড়ি আছে। সে বাড়ি ভাড়া থেকে আয়ের অর্থ দিয়ে চলত ইমরানের বিধবা মায়ের সংসার। ইমরানের মৃত্যুর পর তার মা এখন একা।
বার্তা কক্ষ