বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের হতাশার শেষ নেই। আবার আশা-ভরসারও কমতি নেই। তবে এটা স্পষ্ট আশার চেয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে নিরাশার সুর বড় করুণ হয়ে বাজে। এর কিছু সুস্পষ্ট কারণও রয়েছে। আগে বাংলা সিনেমা নিয়ে কিছু হতাশার কথা বলতে চাই। বাংলা সিনেমা দর্শক হারাচ্ছে এ কথা নতুন নয়। দর্শক শূন্যতার কারণেই একের পর এক হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা শিল্প থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্টতা।
মূলত সিনেমা বানানোই হয় দর্শকদের উদ্দেশ্য করে। হলে যদি দর্শক না থাকে, তবে প্রেক্ষাগৃহগুলো টিকবে কিভাবে? দর্শকরা হল বিমুখ কেন হচ্ছেনÑএর উত্তরে বাংলা সিনেমার গল্প দুর্বল, কাহিনী নকল করা যেমন সত্য; তেমনি এ জন্যে ইউটিউব, অনলাইনের ভূমিকাও কম নয়। বাংলা সিনেমাগুলোর চারভাগের সাড়ে তিনভাগই দুর্বল গল্প নিয়ে গড়ে উঠে। একটি গল্পকেই যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার চিত্রনাট্যে রূপ দেয়া হচ্ছে। নায়কের বাবা ধনী, নায়িকা গরিব অথবা নায়িকার বাবা ভিলেন, নায়ক প্রতিবাদীÑহাঁটতে গিয়ে ধাক্কা লেগে প্রেমে পড়াÑছবির শেষ দৃশ্যে মারামারি এবং পুলিশের আগমণÑআইন নিজের হাতে তুলে নিবেন নাÑএর মধ্য দিয়ে বাংলা ছায়াছবি শেষ হয়।
অধিকাংশ চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্য দেখে সাধারণ দর্শকও বলে দিতে পারেন ছবির শেষে কি হবে! এরকম ধরা-বাঁধা ফ্রেমের বাইরে যেন বাংলা চলচ্চিত্র যেতে পারছে না। গল্পের অভাব, নতুনত্বের অভাব, পরিচালকের মুন্সিয়ানার অভাব, অর্থের অভাবÑএসব অভাব ছায়াছবির পেছনে আঠার মতো লেগে আছে। অস্বীকার করার উপায় নেইÑএমন সব চিত্র দর্শকদেরকে বাংলা সিনেমাবিমুখ করেছে।
কথায় আছে, চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যাÑযদি ধরা না পড়ে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের পরিচালকরা এ ধরা না পড়ার ঝুঁকি নিয়ে কখনো অন্যের গল্প, চিত্রনাট্য হরহামেশাই নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এ কপি-পেস্ট কাহিনী কেবল এ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং উপমহাদেশব্যাপী ছড়ানো। বহুদিন আগে ‘বøাকমেইল’ ছবিটি দেখলাম। কিন্তু শেষ পযন্ত আমাকে হতাশই হতে হলো। কয়েকজন জানালেন, ছবিটির কাহিনী হিন্দির ‘গুন্ডে’ ছবি থেকে মেরে দেয়া হয়েছে। ‘গুন্ডে’তে দু নায়ক এক নায়িকা ছিলো, বøাকমেইল চলচ্চিত্রে সেটাকে দুই নায়িকা, এক নায়কে রূপ দিয়েছেন পরিচালক অনন্য মামুন।
এখানে কথা হলোÑআরেকদেশের ছবিকে কেন কপি করতে হবে আমাদের? শুধু কাহিনী কেন, বাংলা সিনেমা অন্যদেশের পোস্টার পর্যন্ত নকল করা শিখেছে। শুধু তাই নয়, অ্যাকশনগুলোও একইভাবে কপি করছে। এটি নির্মাতারা কীভাবে নিচ্ছেন জানি না, তবে এর মতো লজ্জার বিষয় আর হতে পারে না। আমরা ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রটির কথা জানি। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি তিনটি শাখায় ‘জাতীয় চলচ্চিত্র ২০১৪’-এ ভূষিত হয়েছিলো।
মুরাদ পারভেজ পরিচালিত এ চলচ্চিত্রটি পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে বিতর্ক ওঠে। বিতর্কের বিষয় : ছবিটির কাহিনী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্প ‘গাছটি বলেছিল’ অবলম্বনে রচিত। অথচ কোথাও লেখকের নাম নেই। তথ্য মন্ত্রণালয় অভিযোগ আমলে নেয় এবং গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পায়। ফলশ্রæতিতে পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ভাবা যায়, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত একটি চলচ্চিত্রও এমন ‘মেরে দেয়া’ হতে পারে! এমন প্রেক্ষিতে বাংলা চলচ্চিত্রের অবস্থা যে কেমন তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
সিনেমা হলের সংখ্যা দিনদিন কমার কথা লেখার শুরুতেই বলেছিলাম। নব্বই দশকে সারাদেশে সাড়ে ১২ শ’ সিনেমা হল ছিলো। এসব সিনেমা হলগুলো দর্শকদের পদচারণায় সমসময়ই সরব ছিলো। হাজার থেকে সিনেমা হল এখন কমতে কমতে কয়েক শয়ে এসেছে ঠেকেছে। ২০১৬ সালের এক জরিপে জানা যায়, দেশে প্রায় তিনশ’ সিনেমা হল রয়েছে। এর মধ্যে সচল রয়েছে ২শ’ ১২টি হল। নব্বইয়ের দশকে কেবল ঢাকাতেই সিনেমা হল ছিলো ৪৪টি। বর্তমানে রয়েছে ২৬টি। নব্বই দশকে ঢাকার জনসংখ্যা চেয়ে বর্তমান ঢাকার জনসংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু বাড়ার পরিবর্তে কমেছে সিনেমা হল। কমেছে দর্শক। ফলে প্রতিনিয়তই হুমকির মুখে পড়ছে সিনেমা শিল্প। বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রটি ধীরে ধীরে তার ঐতিহ্য ও গৌরব হারাচ্ছে।
আমাদের মনে থাকার কথা, বাংলা সিনেমা দেখার জন্যে কত অধীর আগ্রহ নিয়ে সাদাকালো টিভির সামনে বিভিন্ন বয়সী মানুষ বসে আছে। উৎসাহ ও আনন্দ নিয়ে তারা ছবি দেখছে। নায়িকার কষ্টে দর্শকরা কাঁদছে, আবার কৌতুক অভিনয়ে তারা হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে। পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি ছিলো বাঙালি জীবনের এক অনন্য অংশ। আমাদের আরো মনে থাকার কথা, সিনেমা হল ছিলো বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। বিভিন্ন বয়সী সিনেমামোদীদের মিলনমেলা।
নতুন ছবি হলে এলেই মাইকিং হতো আর মানুষ ছুটতো হলের দিকে। যে করেই হোক ছবিটি দেখা চাই-চাই-ই। এমন অসংখ্য মানুষ ছিলো যারা কোনো ছবি ভালো লাগলে সেটি কয়েকবার দেখতেন। অন্যদিকে পরিচালকরাও ছবি বানিয়ে লাভবান হতেন। আশি-নব্বইয়ের দশকে সিনেমা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা তারা লাভের মুখ দেখেছেন। সিনেমাকে শিল্পী-কলাকুশলীরা যেমন দুহাত ভরে দিয়েছেন, তেমনি সিনেমাও অর্থ-বিত্ত দুই-ই তাদেরকে দিয়েছে। বর্তমানে সিনেমা নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বেড়েছে সার্বিক সুযোগ সুবিধাও। অথচ এতো কিছু সত্তে¡ও, এত আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নিয়েও সিনেমা শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। যেখানে সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে এগিয়ে যাবার পরিবর্তে সাজঘরে ফেরার পথ ধরছে যেন চলচ্চিত্র শিল্প।
আমি মনে করি, দুর্বল গল্পের পাশাপাশি কৃত্রিমতা চলচ্চিত্রকে উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক। অভিনয় যখন জীবনঘনিষ্ট না হয় তখন সেটা স্বাভাবিকভাবেই মানুষ নিবে না। বাংলা সিনেমার সংলাপে, শিল্পীদের অভিনয়ে, স্থান ও কালের ঐক্যে প্রায়শই কৃত্রিমতার আবরণটি বড় আকারে ধরা পড়ে। অভিনয়কে যতোটা বাস্তবমুখী জীবন্ত করা যায়, ততোই তা দর্শকদের হৃদয়গ্রাহী হয়। গুণী শিল্পীর বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি অভিনয় যে করছেন, অভিনয় এতোটা নিখুঁত হচ্ছে যে বোঝাই যাচ্ছে না এটা অভিনয়।
কৃত্রিমতা হয়তো একটা আবেগ সৃষ্টি করেÑতবে সেটা ফাঁপা ও ক্ষণস্থায়ী। সিনেমা সত্যিকার অর্থেই কল্পনার দুনিয়া। টাইটানিক ছবিটি অনেকেই দেখে থাকার কথা। এ ছবির অভিনয়শিল্পীদের দক্ষতা দেখে কি মনে হয়েছে, এ কাহিনী সব সাজানো, অভিনয়? নাকি নায়কের করুণ মৃত্যু আমাদের মনে গেঁথে থাকে, তার জন্যে হৃদয় কাঁদে? সংলাপ প্রক্ষেপন, শিল্পীর অঙ্গভঙ্গীতে সিনেমার ভালো-মন্দ নির্ণিত হয়। অথচ আমাদের সিনেমা ইন্ড্রাস্টিতে এর অভাব প্রকটভাবে লক্ষ্যণীয়। এর থেকে যে কোনো মূল্যেই বের হতে হবে। নতুবা, অধঃপতন কখনোই আমরা রোধ করতে পারবো না।
বাঙালি বড় ‘তাড়াহুড়ো’র জাতি। সবকাজেই তাড়াহুড়ো। সিমেনার জগৎটা আরো ব্যস্ততার। নায়কের ব্যস্ততা, নায়িকার ব্যস্ততা, পরিচালকের ব্যস্ততা, টিভি চ্যানেলের ব্যস্ততাÑসবমিলিয়ে যত দ্রæত কাজ শেষ করা যায়, ততোই যেন মঙ্গল। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষ সত্যজিৎ রায় কত না নিষ্ঠার সাথে কাজ করতেন। তিন-চার মিনিটের শর্টের জন্যে ত্রিশ-চল্লিশ দিন কষ্ট করতেন। অথচ তার উত্তরসূরী হিসেবে সে দৃষ্টান্তকে যেন আমরা দৃষ্টির বাইরে রেখেছি। সিনেমার বাজেট দিনদিনই কমছে। বড় বাজেটের চলচ্চিত্র কম হচ্ছে। বাজেট কম থাকায় অনেকসময় পরিচালক বাধ্য হয়ে দ্রæত শুটিং শেষ করছেন।
অথবা বেশি বেশি ইনডোরে কাজ করছেন। সে দৃশ্যটা আউটডোরে হওয়ার কথা, টাকা বাঁচানোর জন্যে সেই দৃশ্যকে পরিচালক বদ্ধরুমে টেনে আনছেন। ফলে যা হবার তা-ই হয়। ইউটিউবের কথা বলেছিলাম। সিনেমা যদি ইউটিউবে পাওয়া যায়, তবে দর্শক হলমুখী হবে কেন? টাকা দিয়ে ছবি দেখবে কেন? পাইরেসির ব্যাপারে আমরা এখনো সচেতন হতে পারি নি। কণ্ঠশিল্পীদের কথা একবার ভেবে দেখা যাক। পাইরেসির কারণে মানুষ ক্যাসেট কিনে গান শোনা ভুলেই গেছে। যে গান নেটে পাওয়া যায়, সে গান টাকা খরচ করে শুনবে কেন? ক্যাসেট কিনলে শিল্পী লাভবান হতেন, কিন্তু ইন্টারনেট থেকে গান ডাউনলোড করলে শিল্পী ওই অর্থে লাভবান হচ্ছেন না। ফলে ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে শিল্পী প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছেন। গানের ক্যাসেটের মতো সিনেমা হলগুলোরও একদিন এমন করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। চরম ক্ষতিগ্রস্তের মুখে পড়তে হবে সিনেমা ইন্ড্রাস্টিকে।
আশা নিয়েই বেঁচে থাকা। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’, ‘আয়নাবাজি’, ‘ভুবন মাঝি’, ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’Ñএমন বেশ কিছু চলচ্চিত্র আমাদের আশার প্রদীপকে জ¦ালিয়ে রাখে। হাতছানি দিয়ে দর্শকদেরকে ভালো সিনেমার সুরম্য জগতে নিয়ে যায়। সর্বশেষ ‘আয়নাবাজি’ দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে দর্শকদের প্রবলভাবে হলমুখী করেছে। হাজার হাজার মানুষ উৎসুক হয়ে সিনেমাটি দেখেছে, অন্যকে দেখতে বলেছে। আয়নাবাজি এ সময়ের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক। ক্ষয়ে যাওয়া ইন্ড্রাস্টির প্রাণ ফেরানোর জন্যে বড় একটি ধাক্কা।
অভিনবত্বের কারণে মানুষ সিনেমাটিকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে। তারমানে মানুষের হৃদয় থেকে সিনেমাপ্রীতি মুছে যায় নি। বরং এর অর্থ এই দাঁড়ায়Ñভালো, ব্যতিক্রমী কিছু পেলে দর্শক সেটাকে লুফে নিবেই। আয়নাবাজির মতো আরো কিছু কাজ আমাদের করতে হবে। তাহলে চলচ্চিত্র শিল্পে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হবে। আমাদের দেশে অনেক প্রতিভাবান মানুষ রয়েছেন। অন্যের গল্প চুরি করা অথবা অন্যের কাহিনী নকল করার চেয়ে নিজের মাথা খাটালে ভালো কিছু সৃষ্টি হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
চলচ্চিত্র জীবনের কথা বলে। চলচ্চিত্র হৃদয়কে নাড়া দেয়, সমাজকে রাঙায়। সিনেমা শিল্পের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই আমাদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পীর দক্ষতা, পরিচালকের নৈপূণ্য, গল্পের অভিনবত্ব, পর্যাপ্ত বাজেট নিয়ে কাজ করতে পারলে এবং পাইরেসি রোধ হলে সিনেমা শিল্প যে নতুন মাত্রা নিয়ে দর্শকদের সামনে আবির্ভূত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা সেই নতুন মাত্রার প্রহর গুণছি।
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।