Home / চাঁদপুর / চাঁদপুর বড়স্টেশন মোলহেডে ‘ইলিশের বাড়ির’র হাতছানি
Selfie-Jone-chandpur

চাঁদপুর বড়স্টেশন মোলহেডে ‘ইলিশের বাড়ির’র হাতছানি

আকাশে ওই সময় মেঘ জমেছিল। ঝিরি ঝিরি ঠান্ডা হাওয়া। তাই বেলা সাড়ে ১১টা বাজলেও রোদের তেজ ছিল না। নদীর পাড় ঘেঁষে থাকা গাছের সারি জায়গাটিকে ছায়া দিয়ে রেখেছে। পাশেই বসার স্থান। সেখানে বসে নদীর দিকে তাকালে মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। নদীতে ঘোরার জন্য পাড়ে বেঁধে রাখা হয়েছে নৌকা।

কথা কয়-কথা কয়-ক্লান্ত নয় নাকো/ এই নদী/ এক পাল মাছরাঙা নদীর বুকের রামধনু/ বকের ডানার সারি শাদা পদ্ম/ নিস্তব্ধ পদ্মের দ্বীপ নদীর ভিতরে/ মানুষেরা সেই সব দেখে নাই/—জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে যে-কেউ মুগ্ধ হয়ে জীবনানন্দ দাশের এই কবিতা আওড়াতে পারেন।

এমন মনোরম দৃশ্য উপভোগের জন্য সকাল-বিকেল সেখানে লোকসমাগম ঘটে। সকাল থেকে বিকেলের দিকে লোকের ভিড় থাকে আরও বেশি। হিমেল হাওয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘেরা জায়গাটি হচ্ছে চাঁদপুর শহরের পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গমস্থল বড় স্টেশন মোলহেড, যেটা মোহনা নামেও পরিচিত। আবার অনেকে একে শহরের ‘ঠোডা’ হিসেবেও বলে থাকেন।

জেলা প্রশাসন জায়গাটিকে ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ নামে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে।

সেখানে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিদিনই শত শত মানুষ ঘুরতে আসেন। এর মধ্যে স্থানীয় লোকজনের সংখ্যাই বেশি। চাঁদপুরের বাইরে আশপাশের জেলা থেকেও অনেক পর্যটক বেড়াতে আসেন সেখানে। তবে দুই ঈদ, পূজা, পয়লা বৈশাখসহ বিভিন্ন সরকারি ছুটির সময় হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম ঘটে।

নদীর পাড় ঘেঁষে তৈরি বসার স্থানে দুই বন্ধুর সঙ্গে বসেছিলেন চাঁদপুর সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নজরুল ইসলাম। বাবুরহাটে তাঁর বাড়ি। বললেন, মাঝেমধ্যেই এখানে বেড়াতে আসেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছিমছাম পরিবেশ আর হাওয়া উপভোগ করতে বেশ লাগে তাঁর। তিনি বলেন, এখানে এলেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়।

সেখানে বসে দেখা যায়, পদ্মা মেঘনার উন্মত্ততা, সূর্যাস্ত, মাছ ধরা, নানা ধরনের নৌযান চলাচলের দৃশ্য। এই বড় স্টেশনের পাশেই রয়েছে পদ্মা, মেঘনার রুপালি ইলিশসহ নানা ধরনের তাজা মাছের বিশাল আড়ত। ঘুরতে আসা অধিকাংশ লোকজন যাওয়ার সময় চাঁদপুরের তাজা মাছ নিয়ে যান। বড় স্টেশনের এক পাশে স্টিমারঘাট, আরেক পাশে লঞ্চঘাট, মধ্যখানে রেলস্টেশন।

জায়গাটি ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কিছু স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। প্রবেশের মুখে রুপালি ইলিশের একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হচ্ছে। ইলিশ মাছের জন্য প্রসিদ্ধ চাঁদপুরকে ‘ইলিশের বাড়ি’ বলা হয়। তাই শহরের আইকন হিসেবে ভাস্কর্যের জন্য ইলিশকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। এই ভাস্কর্যকে ‘সেলফি জোন’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে বলে জানা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চাঁদপুরে ব্যাপক গণহত্যার সাক্ষী বধ্যভূমিটিও সেখানে। সেই বধ্যভূমির স্মৃতিরক্ষার্থে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর কিছুটা দূরে শিশুদের খেলার স্থান। আরেক পাশে চটপটি, ফুচকা, ঝালমুড়ি বিক্রির জন্য বসে রয়েছেন কয়েকজন বিক্রেতা। অল্প কয়েকজন ক্রেতা খাবার কিনছেন। আরেক পাশে সারি করে রাখা ভ্যানে নারীদের ইমিটেশনের গয়না, টিপ, শিশুদের খেলনা, ক্লিপ, চুলের ব্যান্ড ইত্যাদি পণ্যের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন কয়েকজন বিক্রেতা।

প্লাস্টিকের বিভিন্ন খেলনা, নারীদের ইমিটেশনের গয়না ও শিশুদের ক্লিপ, ব্যান্ড সাজিয়ে রেখেছেন—এমন এক বিক্রেতা মো. রফিক। কাছে কাঁচা কলোনিতে তাঁর বাসা। রফিক জানালেন, বিকেলের দিকে ভিড় বেশি হয়। এর মধ্যে ছুটির দিনে লোকসমাগম বাড়লে তাঁর বিক্রিও বেশি হয়। গড়ে প্রতিদিন ৬০০ টাকার পণ্য বিক্রি করেন। তবে ছুটির দিনে বিক্রি হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই পণ্য বিক্রির আয় থেকে চলে তাঁর সংসার। পরিবারে আছে বাবা-মা, স্ত্রী, দেড় মাস বয়সী কন্যা আর দুই ভাইবোন।

পণ্য বিক্রিতে সহায়তা করার জন্য রকি নামের এক কিশোরকে সঙ্গে রেখেছেন। তাঁর দাবি, পড়াশোনা বাদ দিয়ে রকি আশপাশে ছেলেদের সঙ্গে শুধু ঘুরে বেড়াত। এ কারণে তাঁর সঙ্গে রেখে ব্যস্ত রেখেছেন। সেই সঙ্গে পাশেই একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক বিনা মূল্যের বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন রকিকে। সারা দিন তাঁকে সহায়তা করে বিকেলে ওই বিদ্যালয়ে যায় রকি।

রকি জানাল, সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।

তবে বিক্রেতা রফিক আফসোসের সুরে বলেন, এখানে পর্যটন স্থান গড়ে তোলার জন্য অনেক কিছু তৈরি হবে। তখন তাঁদের মতো বিক্রেতাদের এখান থেকে সরে যেতে হবে। এখন এখানে পণ্য বিক্রির জন্য কাউকে কোনো ভাড়া বা চাঁদা দিতে হয় না বলে তিনি জানান।

কয়েক বছর ধরে সেখানে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন পুরান বাজারের বাসিন্দা সমীর। বললেন, আগে তিনি সেখানে একাই ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন। এখন আরও কয়েকজন ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। তাই প্রতিযোগিতায় পড়ে তাঁর আয় আগের চেয়ে কমে গেছে। দিনে এক হাজার টাকার ঝালমুড়ি বিক্রি হলে অর্ধেক পরিমাণ অর্থই তাঁর লাভ থাকে বলে জানালেন।

পরিকল্পিত পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ
চাঁদপুর জেলা প্রশাসন বড় স্টেশনের এই জায়গাকে ইতিমধ্যে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। জায়গাটি সরকারি রেলওয়ে ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) হওয়ায় জেলা প্রশাসন থেকে এ জায়গা পর্যটন করপোরেশনকে দেওয়া আবেদন করা হয়। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে রেলওয়ে পাঁচ একর ও বিআইডব্লিউটিসি ২০ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে।

এদিকে বড় স্টেশন মোলহেডের এই জায়গা নিয়ে চাঁদপুর পৌরসভার পরিকল্পনাবিদ সাজ্জাদ হোসেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি নকশা তৈরি করেছেন। তাঁর নকশা অনুসারে, সেখানে নিরাপত্তাবেষ্টনীর ভেতর আকর্ষণীয় প্রবেশগেট, ওয়াকওয়ে, কেনোপি কেসকেইড, গার্ডেন, ফুডকোর্টসহ রেস্টুরেন্ট, কিডস জোন, ওয়াটার ওয়ার্ড থাকবে।

সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। খুবই অল্প খরচে এটা করা সম্ভব। বাস্তবায়নের এক বছরের মধ্যে ব্যয় উঠে আসবে।

এ ব্যাপারে চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক ও বর্তমান পর্যটন করপোরেশনের পরিচালক মো. আব্দুস সবুর মণ্ডল বলেন, ‘আমি চাঁদপুরকে নিয়ে একটি স্বপ্ন দেখছি। সে লক্ষ্যে কাজও চলছে।’

তবে স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি, চাঁদপুরের বড় স্টেশন এলাকায় রেলওয়ে ও বিআইডব্লিউটিসির জমি থেকে অবৈধ স্থাপনা ও ব্যক্তিদের উচ্ছেদ করতে হবে। তা না হলে জায়গাটিকে পরিকল্পিত পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণ হবে না। (উৎস- প্রথম আলো অনলাইন)

Leave a Reply