Thursday, April 09, 2015 07:19:01 PM
পটুয়াখালী প্রতিনিধি :
ভোরে সাগরের গর্জনে ঘুম ভাঙ্গে তাদের। এরপর কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা।
প্রকৃতির এ নিয়মে জীবনগাথা পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতাচাপলি ইউনিয়নবাসীর। এখান থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত, যেখান থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখা যায়।
সেদিনও সাগরের গর্জনে ঘুম ভাঙ্গে লতাচাপলিবাসীর। কিন্তু কর্মব্যস্ত জীবনে হঠাৎই ছন্দপতন ঘটে তাদের। দু’জন অসহায় নর-নারীর ওপর বর্বর নির্যাতন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন নিরীহ মানুষগুলো। এলাকার প্রভাবশালীরা নির্যাতনকারী হওয়ায় অসহায় এই মানুষগুলো টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারেননি।
দুলাভাই-শ্যালিকার মধ্যে ‘অনৈতিক’ সম্পর্কের অভিযোগ তুলে ২৯ মার্চ লতাচাপলি ইউনিয়ন পরিষদ হলরুমে সালিশ বৈঠকে তাদের ওপর করা হয় বর্বর নির্যাতন। এ সময় সেখানে শতাধিক লোক উপস্থিত ছিলেন।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ওই ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু সায়েদ ফকির হাতে লাঠি নিয়ে একের পর এক মিজানুর রহমানের (৩০) হাতে ও পায়ে বেত্রাঘাত করে যাচ্ছেন। বেত্রাঘাত সহ্য করতে না পেরে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছেন মিজানুর। সাদা-পায়জামা পাঞ্জাবি পরা এই জনপ্রতিনিধির তাতে একটুও মন গলেনি। তিনি পর পর ৮০ বার বেত্রাঘাত করেন।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এরপর শ্যালিকাকে একই কায়দায় বেত্রাঘাত করা হচ্ছে। বেত্রাঘাত করছেন সাবেক ইউপি সদস্য মিনারা বেগম। কালো রঙের বোরকা পরা আর মাথায় সাদা রঙের ওড়না পেঁচানো এই জনপ্রতিনিধি পর পর ৩০ বার বেত্রাঘাত করেন ওই তরুণীকে।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য সাবেক ইউপি সদস্য মিনারা বেগমকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।
বর্বর নির্যাতনের এই কাহিনী এখানেই শেষ নয়। এরপর মিজানুর রহমানের পুরুষাঙ্গে ইট বেঁধে হলরুমে ঘোরানো হয়। বৈঠকে মিজানুর রহমানকে জরিমানা করা হয় ২৫ হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান আবু সায়েদ ফকির বলেন, ‘ওই মেয়ের বাবা-চাচারা বিচার চেয়েছেন, তাই বিচার করেছি। সব বিচার আইনসঙ্গতভাবে করা যায় না।’
একই সময়ে আরেক জনপ্রতিনিধি ইউপি সদস্য সোহরাব হোসেনের ফেলা থু-থু চেটে খেতে বাধ্য করা হয় ওই তরুণীকে।
এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ইউপি সদস্য সোহরাব হোসেন বলেন, ‘অনেক মানুষ বিচারে উপস্থিত ছিল। তারা দেখেছে, চেয়ারম্যান থু-থু ফেলতে বলেছে, তাই ফেলেছি।’
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন কুয়াকাটা পৌর ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক তৈয়বুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা জুলহাস খান, ফাসিপাড়া গ্রামের মজিবর হাওলাদার, খাজুরার জলিল মোল্লা প্রমুখ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি ওই তরুণীর সঙ্গে তার চাচাতো ভাই ফেরদৌসের বিয়ে হয়। স্বামীর সংসার করতে না চাওয়ায় তাদের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এরই মধ্যে ওই তরুণীর বড় বোনের স্বামী মিজানুর রহমান তাকে নিজ বাড়িতে বরগুনার কুয়াকাটার খাজুরা গ্রামে (একই গ্রামের অন্য প্রান্ত) নিয়ে যান।
এ ঘটনার পর ওই তরুণীর বাবা কলাপাড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মিজানুরকে অভিযুক্ত ১৫ মার্চ একটি মামলা করেন।
আদালত ইউপি চেয়ারম্যান আবু সায়েদ ফকিরকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের কপি ইউপি চেয়ারম্যান আবু সায়েদ ফকির ২৯ মার্চ হাতে পান। ওইদিনই সালিশ-বৈঠকের নামে তরুণী ও তার দুলাভাইয়ের ওপর বর্বর এই নির্যাতন করা হয়।
বৈঠকে ওই তরুণীর বিয়েও ভেঙ্গে দেওয়া হয়। স্বামী ফেরদৌসকে ডেকে কাগজে সই নিয়ে তালাক কার্যকর করা হয়। এ ছাড়াও বড় বোনের চার বছরের সংসার জীবন আগামী এক মাসের মধ্যে স্থায়ীভাবে ভেঙ্গে দেওয়ারও ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই বিচারের রায় কার্যকরের পর থেকেই খাজুরা গ্রামের শ্রমজীবী দরিদ্র ওই পরিবারটি অসহায়, দিশেহারা, সমাজে ‘অবাঞ্চিত’ হয়ে নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। ভীতসন্ত্রস্ত এ পরিবারের লোকজন দিনেরবেলাও দরজা বন্ধ করে থাকছেন। এ খবর যাতে নির্যাতিত পরিবারটি কাউকে বলতে না পারে সে জন্য সালিশকারীদের পক্ষ থেকে তাদের রাখা হয়েছে কড়া পাহারায়।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা নিজেদের মানসিক যন্ত্রণা থেকে এ সব তথ্য সংবাদকর্মীদের জানালে সরজমিনে বুধবার দেখা যায়, এ ঘটনার আট দিন পরও বেত্রাঘাতে অসুস্থ ওই তরুণী শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠেনি। কথা বলতে গিয়ে ব্যথায় মুচড়ে উঠছেন। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। তিনি জানান, মিথ্যে অপবাদে তার যে ক্ষতি হয়েছে তা কীভাবে দূর হবে সেই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। অপমানের এই যন্ত্রণার হাত থেকে তিনি বাঁচতে চান।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সালিশ বৈঠকের বর্বর রায় মানতে তাদের বাধ্য করা হয়। প্রভাবশালী সালিশকারীরা তাকে অন্যের মুখের থু-থু খেতে বাধ্য করে। চিকিৎসা নিতেও সৃষ্টি করা হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। পরিবারের সব সদস্যই আতঙ্কে রয়েছেন।
ওই তরুণীর বাবা কথা বলেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন খবর প্রকাশিত হলে প্রতাপশালী সালিশকারীদের রোষানলে পড়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার পরিবার।
কুয়াকাটার খাজুরা গ্রামে গিয়ে মিজানুর রহমানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিন বছরের কন্যা সন্তান নিয়ে তার স্ত্রী শঙ্কার মধ্যে দিনযাপন করছেন। তিনি বলতে পারেননি মিজানুর রহমান কোথায় আছেন।
এ ব্যাপারে কলাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আজিজুর রহমান জানান, বিষয়টি মাত্র অবগত হয়েছেন তিনি। খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
https://www.youtube.com/watch?feature=player_detailpage&v=pla-dnqwo24
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur