মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, সারাদেশে সংঘটিত শতকরা প্রায় ৮০টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে মাদকদ্রব্যের সম্পৃক্ততা রয়েছে। অধিদপ্তরের গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য মতে, বর্তমানে মাদকাসক্তের শতকরা ২৫ ভাগই ইয়াবা আসক্ত।
সংশি¬ষ্টদের মতে, ইয়াবা ট্যাবলেট পরিবহন ও সেবন সহজ হওয়ায় সহজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়ানো যায়। এ কারণে এ নেশার চোরাচালান বাড়ছে।
পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এর ইন্সপেক্টর মাহফুজ ও তার স্ত্রী স্বপ্না খুন হবার পর আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর মাদকদ্রব্য ‘ইয়াবা’। এ ঘটনার পেছনে পুলিশ ওই দম্পতির ১৬ বছরের কন্যা ঐশির সংশি¬ষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে। যে কিনা ইয়াবায় আসক্ত বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
এই ইয়াবার কারণেই বাবা-মায়ের সঙ্গে ঐশির সাপে-নেউলে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তা রূপ নেয় খুনে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ১২ হাজার ৩০৪ জন মাদকাসক্ত চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের বেশিরভাগই ইয়াবার নেশায় আসক্ত।
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রথমদিকে ইয়াবা যৌনউত্তেজক বড়ি হিসাবে বাজারে পরিচিত ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন সেবনের ফলে যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়। যুক্তরাজ্যের ড্রাগ ইনফরমেশন এর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ইয়াবা ট্যাবলেটটি খেলে সাময়িকভাবে উদ্দীপনা বেড়ে যায়। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হেরোইনের চেয়েও ভয়াবহ। আসক্ত তরুণ-তরুণীরা জীবিত থেকেও মৃত। ইয়াবা সেবনে একজনের সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা, অনিদ্রা, খিটখিটে ভাব ও আগ্রাসী প্রবণতা বা মারামারি করার ইচ্ছা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, বমি ভাব, ঘাম, কান-মুখ লাল হয়ে যায়া। তার মধ্যে শারীরিক সঙ্গের ইচ্ছা বেড়ে যায়। তবে এ সবই অল্প কয়েক দিনের বিষয়। সেই সঙ্গে বাড়ে হƒদস্পন্দনের গতি, রক্তচাপ, শরীরের তাপমাত্রা। এছাড়া স্মরণশক্তি কমে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয় এবং কারও কারও সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে পাগল হয়ে যায়। লেখাপড়ায় খারাপ হয়ে এক সময় ডিপ্রেশন বা হতাশাজনিত নানা রকম অপরাধ প্রবণতা, এমনকি আত্মহত্যাও করে থাকে। হার্টের ভেতরে ইনফেকশন হয়ে বা মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিঁড়েও অনেকে মারা যায়। অনেকের মৃত্যু ঘটে রাস্তায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে। কেউ কেউ টানা ৭ থেকে ১০ দিন জেগে থাকে। তারপর ড্রাগ ওভার ডোজেও মরে যায়। মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে এবং কারও কারও এগুলো ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। কিছুদিন পর থেকে ইয়াবাসেবীর হাত-পা কাঁপে, হ্যালুসিনেশন হয়, পাগলামি ভাব দেখা দেয়, প্যারানয়া হয়। হ্যালুসিনেশন হলে রোগী উল্টোপাল্টা দেখে, গায়েবি আওয়াজ শোনে। আর প্যারানয়াতে ভূগলে রোগী ভাবেÑ অনেকেই তার সঙ্গে শত্র“তা করছে। তারা অনেক সময় মারামারি ও সন্ত্রাস করতে পছন্দ করে। কারও কারও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, খিঁচুনি হয়। খিটখিটে ভাব, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুর, নার্ভাসনেসে ভূগতে থাকে ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তিরা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জাতীয় মানসিক ব্যাধি ইনস্টিটিউটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সম্ভবত ঐশি প্যারানয়াতে ভুগছিল। এতে যারা ভোগে তারা ইয়াবায় মারাÍক আসক্ত থাকে। এ পর্যায়টি ভয়াবহ। খুন করতে দ্বিধা করে না আসক্ত ব্যক্তি। ঐশির ক্ষেত্রেও সম্ভবত তাই হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করলে ইয়াবার আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে শারীরিক ক্ষতি পুরোপুরি সারানো সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই আসক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশের টেকনাফ বর্ডার দিয়ে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম প্রবেশ করে ১৯৯৭ সালে। কিন্তু এর আগে ইয়াবার নানা উপাদানকে প্রাণরক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন ডাক্তার। ২০০১ সালে বাংলাদেশের অভিজাত এলাকাগুলোতে ইয়াবা তরুণ-তরুণীদের মানিব্যাগে স্থান করে নেয়। এখন এ নেশাদ্রব্য ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর অলিগলির মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মাঝেও। নেশা গ্রহণকারীদের তালিকায় স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে, ব্যবসায়ী, গ¬্যামারজগতের বাসিন্দা থেকে শুরু করে গৃহবধূ পর্যন্ত। ইয়াবার নেশার টাকা যোগাড় করতে গিয়ে অনেক ছেলেমেয়েরা অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছে। ইয়াবা ট্যাবলেটে আসক্ত শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাই বেশি। তা-ও তারা সাধারণ কিংবা মধ্যবিত্ত নয়, অভিজাত এলাকার ধনীর দুলাল-দুলালী। পিতা-মাতারা কোটি কোটি টাকার দিকে ছুটছে আর বিলাস বহুল জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের আদরের দুলাল-দুলালীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ফাঁকে মরণ নেশায় আসক্ত। অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পিতা-মাতা একটু সচেতন হলে ইয়াবার মরণ ছোবল হতে তাদের মেধাবী সন্তানদের রক্ষা করা সম্ভব হত। ইয়াবা একবার সেবন করলে সে আর এটা ছাড়তে পারবে না। সে ইয়াবার পিছনে ছুটতে থাকবে।’
এদিকে, অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সের জনসংখ্যার বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক গ্রহণের সঙ্গে জড়িত। ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ মাদকাসক্তের প্রভাবে বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমাজের সব স্তরে। সম্প্রতি বাংলাদেশে মাদকাসক্তির হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আর এদের বেশিরভাগেরই বয়সসীমা ১৫ থেকে ৩৫। যার মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের বয়স আবার ১৫ থেকে ২০ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, মাদকাসক্তির কারণে বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় মহিলারা উল্লেখযোগ্য হারে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, রাজধানীতে প্রতি মাসে মাদক সংক্রান্ত প্রায় ৮ হাজার মামলা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের এক জরিপে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ লাখ লোক মাদকাসক্ত। কারও কারও মতে, এ সংখ্যা ৮০ লাখেরও বেশি, যার প্রায় ৭ শতাংশই স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রী। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই প্রায় ২০ লাখ লোক মাদকাসক্ত। যার ৭৫ ভাগ হেরোইন ও ৩০ ভাগ ফেনসিডিলে আসক্ত। এদের মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ, ১৩ ভাগ নারী। আর শতকরা ৮৫ ভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী এবং শিশু-কিশোরসহ প্রায় ৩ লাখ লোক নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩৯ লাখ ৪২ হাজার লোক মাদক সেবনে মারা যায়। অর্থাৎ প্রতি সাড়ে ৬ সেকেন্ডে একজন করে মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে শুধু তামাক জাতীয় পণ্য ব্যবহার করে মারা যায় প্রায় ৫৭ হাজার লোক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল এ প্রতিবেদককে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি নেশাগ্রস্থ হচ্ছে ইয়াবায়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফেনসিডিল। আমরা অত্যন্ত গতির সঙ্গে এর যোগান বন্ধকরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। তবে মাদকের চাহিদা যদি রোধ না করা যায় তাহলে আমরা যত কঠোর ব্যবস্থাই নিই কোনো কাজে আসবে না। মাদকের পেছনে আসক্তরা প্রচুর অর্থ খরচ করে, অনেক ঝুঁকি নেয়। মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘কোনো মাদকাসক্ত যদি চিকিৎসা নিতে চায় তাহলে আমাদের কেন্দ্রীয় মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র তার জন্য সবসময় খোলা। প্রয়োজনে পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে।’ তিনি বলেন, ‘মাদক প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গণমাধ্যমের অবস্থানকে শক্তিশালী করা আবশ্যক। গণমাধ্যমের পক্ষে অনেক শক্তিমান কাজ করা সম্ভব।’
এ প্রসঙ্গে তামাক বিরোধী জোটের সংগঠক আমিনুল ইসলাম বলেন, ক্রমাগত মাদকের ব্যবহারে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে মাদকাসক্ত ব্যক্তির ও পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা, আচরণগত সমস্যা, চিন্তার স্বল্পতা ইত্যাদি সমস্যা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়, যা সমাজে চরম নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি মাদকাসক্ত ব্যক্তির পর্যাপ্ত অর্থের যোগান না থাকলে সে ছিনতাই, চুরিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ থেকে তার ভেতর দেখা দেয় আচরণগত সমস্যা বা ত্র“টি। একপর্যায়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির চিন্তার স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়। তখন সে কোনো বিষয়ের গভীরে চিন্তা করতে পারে না। ফলে এ ধরনের ব্যক্তিরা যে কোনো সময় অন্য যে কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করতে দ্বিধা করে না। এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতে পারে। যে পরিবারে মাদকসক্ত কোনো সদস্য থাকে অনেক ক্ষেত্রেই সেই পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হয়। অর্থাৎ মাদকের ব্যবহারের ফলে যে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয় তা পরবর্তীতে প্রচণ্ড সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়।
এ সমস্যা সমাধানে করণীয় সম্পর্কে আমিনুল ইসলাম বলেন, এজন্য সমাজের সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মাদকের সহজলভ্যতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে যেন মাদক প্রবেশ করতে না পরে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে এবং প্রচার বাড়াতে হবে।
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫