Home / চাঁদপুর / হাটু কাদায় মাছ ধরতে নেমে পড়া নিরহংকারী নারী এসপি শামসুন্নাহার
Samsunnahar-
চাঁদপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনের পুকুরে হাটুজল কাদায় মাছ ধরতে নেমে পড়লেন এসপি শামসুন্নাহার।

হাটু কাদায় মাছ ধরতে নেমে পড়া নিরহংকারী নারী এসপি শামসুন্নাহার

চাঁদপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনের পুকুরে দমকল দিয়ে পানি সেঁচে সেখানে কাদাজলে চলছিলো চাষকৃত জিয়ল মাছ ধরার উৎসব। হঠাৎ করে সেলোয়ার-কামিজ পরেই হাঁটুসমান সেই কাদামাটিতে নেমে পড়লেন কোনো এক নারী।

তিনি অন্য পুলিশ সদস্যদের সাথে আনন্দচিত্তে কাদাজলে নেমে একটা একটা মাছ ধরে ঝুড়িতে রাখছেন। মুহূর্তেই তিনি বনে গেলেন শৈশবের কোনো এক দূরন্ত কিশোরী। পুকুরের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যরাও বিস্মিত।

গ্রামের পরিবেশে বড় হওয়া এ নারী ক্ষণিকের জন্যে হারিয়ে গেলেন শৈশব স্মৃতিতে, ভুলে গেলেন তিনি চাঁদপুর জেলার সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত এসপি শামসুন্নাহার পিপিএম।

তাঁরাও অবাক হয়ে দেখলেন পুলিশের উচ্চ পদের কর্মকর্তা হয়েও সাধারণ মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে কিভাবে তিনি অসাধারণ হয়ে উঠেন একজন পুলিশ সুপার।

সাথে সাথে সুন্দর মুহূর্তটি নিজেদের স্মাটফোনের ক্যামেরায় ধারণ, অত:পর সোস্যাল মিডিয়ায়। ইতিবাচক সাড়া মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল, এ যেনো এক নিরহংকার পুলিশ সুপার।

তবে সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো নিজ হাতে পুুকুর থেকে ধরা মাছগুলো তিনি সবার মাঝে বিতরণ করে দিয়েছেন। একটি বড় মাছও তিনি নিজের জন্য রাখেননি। তবে পুলিশ সদস্যদের অনুরোধে অনেকটা বাদ্য হয়েই ছোট ছোট কয়েকটা তেলাপিয়া মাছ নিয়েছেন।

আত্মঅহংকার, উগ্রতা কিংবা ক্রোধকে পদদলিত করে নিজেকে সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে আসা সত্যিকার অর্থের এই জনবান্ধব পুলিশ সুপারের জন্ম ফরিদপুর জেলায়।

যিনি নারী পুলিশ হিসেবে পরপর দুইবার জাতীয় পুলিশ প্যারেডে নেতৃত্ব দিয়ে প্রধানমমন্ত্রী নজর কাড়ার পাশাপাশি গড়েছেন এক বিরল রেকর্ড।

আত্মঅহংকার, উগ্রতা, হিং¯্রতা কিংবা ক্রোধকে পদদলিত করে নিজেকে সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে আসা সত্যিকার অর্থের এই জনবান্ধব পুলিশ সুপার গত ২০১৫ সালের ১২ জুন শুক্রবার চাঁদপুরে যোগদান করেন।

চাঁদপুরে যোগদানের সাথে সাথে তিনি মাদক, সন্ত্রাস, বাল্য বিয়ে ও নারী-শিশু নির্যাতনের ব্যাপরে জিরো টালারেন্স ঘোষণা করেন এবং অনেকগুলো ইতিবাচক কর্মকান্ডে জনমনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এ জেলার কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম বেগবান করেন পরপর দুইবার কমিউনিটি পুলিশিং সমাবেশে সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হককে এবং বর্তমান আইজিপি মো. জাবেদ পাটওয়ারীকে প্রধান অতিথি করে চমক সৃষ্টি করেন।

এছাড়া পুলিশ সুপার পদে চাঁদপুর আসার প্রথম বছরেই জাতীয় পুলিশ প্যারেডে প্রথম নারী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সারাদেশে বেশ আলোচিত হন।

তিনি বিশ্বাস করেন, শুধুমাত্র শাস্তি দিয়ে নয় সামাজিক অপরাধ নিমূলে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। আর এজন্য নিজে স্ব-শরীরে মাদক ব্যবাসায়ীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পরিবারকে সতর্ক করার পাশাপাশি এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন হাট বাজারে গিয়ে মাদক, বাল্যবিয়ে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন।

পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার নির্যাতিত নারী ও শিশুদের কথা চিন্তা করে ২০১৫ সালে ১৫ অক্টোবর নারী পুলিশ সুপার কার্যালয়ে অভিযোগ সেল গঠন করে প্রতিদিন নির্যাতিত নারী ও শিশুরা সেবা দিচ্ছেন। চাঁদপুরবাসীর বিশ্বাস পুলিশ পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার হয়তো একদিন পনোন্নতি পেয়ে আরো উচ্চতায় পৌঁছে যাবেন। তবে তার সৎ কর্ম চাঁদপুর তথা বাংলাদেশে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এক নজরে পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারের জীবন বৃত্তান্ত-

চার ভাইবোনের মধ্যে শামসুন্নাহার সবার বড়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও এমফিল সম্পন্ন করার পর স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

তারা ২ বোন ও ২ ভাই। সবার বড় তিনি। মা-বাবার স্বপ্নও তাকে নিয়ে ছিল আকাশ ছোঁয়া। মেজো ভাই ডাক্তার। সেজো ভাই হাইকোর্টের আইনজীবী। সবার ছোট বোন স্কুলের শিক্ষিকা। দুই সন্তানের জননী এই সফল নারী।

১৯৯১ সালে ভর্তি হন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন ব্যারিস্টার হওয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে চান্স না পেয়ে ভেঙে যায় স্বপ্ন। পরবর্তীতে ভর্তি হন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।

এক অনুষ্ঠানে শামসুন্নাহার বলেন, ‘প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ লাগতো কাঙ্খিত সাবজেক্টে পড়তে না পেরে। কিন্তু পরবর্তীতে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের ভালবাসায় আর সহপাঠীদের সহযোগিতায় ভালো লাগতে শুরু করে সবকিছু।’

বেগম রোকেয়া হলে থাকাকালীন যোগ দেন বিএনসিসিতে। বিএনসিসি’র বিমান শাখার ক্যাডেট ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে বিএনসিসি’র পক্ষ থেকে যশোরে যান। সেখানে বিমানবহিনীর কার্যক্রম দেখে মুগ্ধ হন। সেখানকার পাইলটদের ইউনিফর্ম, নিয়ম-শৃঙ্খলা, জীবন প্রণালি মুগ্ধ করে তাকে। আর তখনই মনে মনে স্বপ্ন দেখতে থাকেন এমন একটা চাকরির যেখানে ইউনিফর্ম পরা যাবে। নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। মূলত ইউনিফর্মটাই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল কিছুটা হেসে বললেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

আর তাই দেরি না করে তখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন বিসিএস’র। ১৯৯৬ সালে অনার্স পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পরই অংশগ্রহণ করেছিলেন ২০তম বিসিএস পরীক্ষায়। নিষ্ঠা আর কঠোর সাধনায় হয়েছেন সফল। প্রথম পছন্দই ছিল পুলিশ। এখনও বিসিএস’র ফল প্রকাশের দিনটির কথা মনে হলে আনন্দিত হন এই পুলিশ সুপার।

ফল প্রকাশের সময় তিনি ছিলেন ৮ মাসের গর্ভবতী। আর তাই ফল প্রকাশের পর যখন ভবিষ্যতে শক্ত, মজবুত অবস্থানের হাতছানি পান তখনই ভেসে যান আনন্দে। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও এমফিল সম্পন্ন করার পর স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তার ভাইবোনও তার মত স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তারা ২ বোন ও ২ ভাই। সবার বড় তিনি।

মা-বাবার স্বপ্নও তাকে নিয়ে ছিল তাই আকাশ ছোঁয়া। মেজো ভাই ডাক্তার। সেজো ভাই হাইকোট্রের আইনজীবী। সবার ছোট বোন স্কুলের শিক্ষিকা।

সুযোগ পেলেই গানের চর্চা করেন। নজরুলগীতি তার সবচেয়ে পছন্দের। বিটিভি’র তালিকাভুক্ত শিল্পী, এই এসপি অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। মুগ্ধ করেন তার সুরের মায়ায় দর্শকদের।

২০০১ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের পর পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশসহ বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের শাখা অফিস ইতালিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ২০০৯ ও ২০১০ সালে পূর্ব-তিমুরে জাতিসংঘ মিশনের জাতীয় পুলিশের মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মকান্ডে দায়িত্ব পালন করেন।

জাতিসংঘে উচ্চপদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন সাতবার জাতিসংঘ শান্তি পদক।

তাছাড়া পুলিশে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য পেয়েছেন দু’বার আইজি ব্যাজ। তার অরেকটি বড় পরিচয় পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬ এ প্যারেডের নেতৃত্ব দেন তিনি।

প্রতিবেদক-আশিক বিন রহিম,
যুগ্ম বার্তা সম্পাদক
চাঁদপুর টাইমস