দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের জন্য উন্নয়ন-সহযোগীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় এবং বিশ্বব্যাপী অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা ছাড়া এটি অর্জন করা যাবে না।’
ইতালির রোমে গতকাল মঙ্গলবার ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) সদর দপ্তরে সংস্থাটির ৪১তম পরিচালনা পরিষদের সভার উদ্বোধনী অধিবেশনে মূল বক্তব্য দেওয়ার সময় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি চার দিনের সরকারি সফরে গত রোববার ইতালি যান।
অধিবেশনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘ফ্র্যাজিলিটি টু লং টার্ম রেজিলিয়েন্স: ইনভেস্ট ইন সাসটেইনেবল রুরাল ইকোনমি’। বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূরীকরণে উন্নয়ন-সহযোগীদের আরও একটু উদার হতে হবে।
বাংলাদেশ ও উন্নয়ন-সহযোগীদের মধ্যে সহায়তা অব্যাহত থাকার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অগ্রগতির এই ধারা অব্যাহত রাখতে ইফাদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা স্থাপন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা যাবে না। গ্রামীণ সামাজিক ও জলবায়ুগত স্থিতিশীলতার উন্নয়নে ব্যাপকভিত্তিক টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি প্রয়োজন। তিনি টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি তৈরিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদিভাবে স্থিতিশীলতা আনার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ৯ বিলিয়ন (৯০০ কোটি) ছাড়িয়ে যাবে এবং এর অর্ধেক হবে মধ্যবিত্ত। এর ফলে বিশ্বের আবাদি জমি, বনভূমি ও পানির ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে অনেক দেশের আবাদি জমি ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব।’
শেখ হাসিনা বলেন, ২০৫০ সালে বিশ্বের খাদ্য চাহিদা ২০০৬ সালের অবস্থান থেকে অন্তত ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে এবং খাদ্যমূল্য বেড়ে ৮৪ শতাংশ দাঁড়াতে পারে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কীভাবে এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করব? আমি আপনাদের আমার দেশের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কৃষি প্রবৃদ্ধির কথা তুলে ধরব, যা বৈশ্বিক পর্যায়ে মানব উন্নয়নে অন্যান্য দেশ গ্রহণ করতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রথমে আমি আপনাদের বলব, প্রতিবছর জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে দেশে খাদ্যসংকট ও খাদ্য উৎপাদন হ্রাসের যেকোনো সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশি জনগণ স্বাভাবিকভাবে সক্ষম। সংকটের মোকাবিলায় বাংলাদেশিরা আস্থার সঙ্গে শক্তভাবে লড়াই করে সমস্যার সমাধান ও সংকট কাটিয়ে উঠতে বিকল্প উপায় গ্রহণের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রায় এক দশক ধরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং চলতি বছর অসময়ে বারবার বন্যায় অপ্রত্যাশিতভাবে খাদ্যঘাটতি দেখা দিয়েছিল। এ ঘাটতি মোকাবিলায় গ্রাহকদের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে সঙ্গে সঙ্গেই খাদ্য আমদানি নীতি গ্রহণ করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না—এই চ্যালেঞ্জই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৭২ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে এবং ৪৩ শতাংশ কৃষি খাতে শ্রমজীবী হিসেবে কাজ করে; যারা দেশের জিডিপিতে ১৫ শতাংশ অবদান রাখছে। গ্রামীণ অকৃষি খাতের কর্মীর সংখ্যা শতকরা ৪০ শতাংশ, যারা গ্রামীণ আয়ের ৫০ শতাংশের বেশি আয় করে। কাজেই অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই গ্রামীণ রূপান্তরই দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা দূর করা ও কাউকে পেছনে ফেলে না রাখার লক্ষ্য অর্জনের মূল শক্তি।’
বাংলাদেশ-ইফাদ ঋণচুক্তি
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ছয়টি জেলার দুস্থ মানুষের অবকাঠামো ও বাজার উন্নয়নে ইফাদের সঙ্গে ৯ কোটির বেশি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি করেছে বাংলাদেশ। গতকাল বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ইফাদ সদর দপ্তরে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আজম এবং ইফাদ প্রেসিডেন্ট গিলবার্ট এফ হুয়াংবো চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
এ সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীও উপস্থিত ছিলেন।
চুক্তি স্বাক্ষর শেষে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয়টি জেলার দুস্থ জনগণের অবকাঠামোগত দক্ষতা উন্নয়ন এবং তথ্যসংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। জেলাগুলো হচ্ছে পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা ও জামালপুর। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এতে এই জেলাগুলোর ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ উপকৃত হবে।
শহীদুল হক বলেন, প্রকল্পের মূল ব্যয়ের ৬ কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার ডলার ঋণ এবং ১২ লাখ ৫০ হাজার ডলার অনুদান হিসেবে দেবে ইফাদ। বাকি ২ কোটি ৭৯ লাখ ডলার বাংলাদেশ সরকার দেবে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এর আগে ইফাদের প্রেসিডেন্ট সংস্থার সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যুও উঠে আসে।
রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবরাহে দাতাগোষ্ঠীর আগ্রহ কমছে
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দাতা সংস্থাগুলোর আগ্রহ হ্রাস পাওয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই মানবিক সংস্থা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
গত সোমবার রোমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালকের বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ডেভিড বিসলেকে উদ্ধৃত করে এসব কথা বলেন।
বৈঠকে ডেভিড বিসলে বলেন, রোহিঙ্গাদের খাওয়ানোর ব্যাপারে দাতা সংস্থার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তবে তাঁরা জাতিসংঘের ব্যবস্থার আওতায় দাতা সংস্থার মধ্যে এ আগ্রহ ধরে রাখতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটি চালিয়ে যাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরেকটি বিষয়ের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক। সেটি হচ্ছে বর্ষাকালে বাংলাদেশের যে স্থানে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে ভূমিধসের সৃষ্টি হতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজন হলে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকে অস্থায়ীভাবে ভাসানচর এলাকায় স্থানান্তর করা হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন প্রচারণার প্রশংসা করেন ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক।
(প্রথম আলো)
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১১: ০০ এ.এম, ১৩ ফেব্রুয়ারি২০১৮,সোমবার ।
এএস.