জন্ম থেকে দুটো হাত নেই মেঘলা জান্নাতের। তবে তার মনের জোর প্রবল। পায়ে লিখে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। জীবনের প্রায় সব পরীক্ষাতেই কৃতিত্বপূর্ণ ফল করেছে। স্বীকৃতিস্বরূপ তার ঝুলিতে আছে অনেক পুরস্কার। এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। মেঘলার এই ফলাফলে তার পরিবারে বইছে খুশির বন্যা।
মেঘলা এবার ঘোড়াশাল সার কারখানা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে পিইসি পরীক্ষা দেয়। জীবনের চেনা গণ্ডির বাইরে এটাই তার প্রথম পরীক্ষা। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও তার নিজের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে পরীক্ষাকেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক আলাদা করে বসার জন্য বিশেষ চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছিলেন। তবে মেঘলা সেই সুযোগ নেয়নি। সবাই যেভাবে পরীক্ষা দিয়েছে, সেও সেভাবেই পরীক্ষা দিয়েছে।
কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের বিষয়ে জানতে চাইলে মেঘলা বলে, ‘আমি খুব খুশি। আমার বাবা, মা আর বোনরাও ভীষণ খুশি।’ সে আরও বলে, ‘আমার কাছে প্রতিবন্ধী শব্দটা ভালো লাগে না। কেউ যখন আমাকে এ রকম বলে তখন খুব কষ্ট লাগে। আমি ক্লাসে প্রথম হতে পারি, আবৃত্তিতে প্রথম হতে পারি, চিত্রাঙ্কনে প্রথম হতে পারি, তবে আমি কেন প্রতিবন্ধী হব।’ বড় হয়ে কী হতে চাও—এমন প্রশ্নে মেঘলা বলে, ‘আমি আমার বড় বোনের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই। ভবিষ্যতে ম্যাজিস্ট্রেট হতে চাই।’
মেঘলাকে পাঁচ বছর ধরে দেখে-শুনে রাখছেন ঘোড়াশাল সার কারখানা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক সেলিনা আখতার জাহান। তিনি বলেন, মেঘলা খুব জেদি, হার মানতে রাজি নয়। ক্লাসে সব সময় প্রথম হতো সে। তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের কোনো ঘাটতি নেই।
মেঘলার বাবা রুহুল আমীন নরসিংদীর পলাশের ঘোড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানার হিসাব সহকারী। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ৩০ বছর ধরে কর্মরত। সেখনকার কোয়ার্টারে তাঁদের বসবাস। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। মেঘলার মা আফিয়া খান গৃহবধূ। মেঘলার বড় দুই বোনের মধ্যে জান্নাতুল ফেরদৌসী লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজে এবং জান্নাত আরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) পড়ছেন।
রুহুল আমীন জানান, মেঘলাকে পড়াশোনার জন্য কখনো চাপ দিতে হয় না। নিয়মিত দু–তিন ঘণ্টা পড়ে সে। বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলাও করে। গল্পের বই পড়তে ও ছবি আঁকতে ভালোবাসে। প্রচুর পুরস্কার পেয়েছে সে। তিনি আরও জানান, মেঘলা নিজেকে কখনো প্রতিবন্ধী ভাবে না। তার আত্মসম্মান বোধ প্রবল।
মেঘলার পিইসির পরীক্ষাকেন্দ্র আদর্শ শিশু শিক্ষা নিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুমুদ রঞ্জন দেবনাথ বলেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা করে ২০ মিনিট বেশি পাওয়ার সুযোগ থাকলেও মেঘলার তা প্রয়োজন হয়নি। অন্য সবার চেয়ে ১০-২০ মিনিট আগেই তার পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত। তার পায়ের লেখা অনেকের হাতের লেখার চেয়েও সুন্দর।
মেঘলার খোঁজখবর নিতেন এবং মাঝে মাঝে বাসায় গিয়ে তাকে পড়া দেখিয়ে আসতেন কাঁঠালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. লুৎফর রহমান। তিনি জানান, ‘মেঘলা জিপিএ-৫ পাওয়ায় ভীষণ খুশি লাগছে। এমন পরিস্থিতিতে পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ এবং মেধা দেখে আমি অভিভূত। তাকে সব সময় উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
জানতে চাইলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন ভূঞা বলেন, ‘জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় মেঘলা জিপিএ-৫ পাওয়ায় খুব আনন্দ লাগছে। পরীক্ষার হলে আমি অনেকবার তাকে দেখতে গিয়েছি। তার মধ্যে প্রতিভা আছে, হার না মানা ভাব আছে। তার অদম্য জেদ আর ইচ্ছা দেখে মনে হয়, মানুষ চাইলে সব পারে।’ (প্রথম আলো)
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৭:৩০ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, রোববার
এএস