বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে লেখক সম্মানীকে অধিকাংশ লেখকই বাড়তি প্রাপ্তি বলে মনে করেন। অথচ এটি যে লেখকের ন্যায্য পাওনা সে কথা অনেকেই ভুলে যান। ফলে কোনো প্রকাশনা মাধ্যম থেকে যখন কেউ সম্মানী পায় তখন ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার অন্ত থাকে না।
বাংলাদেশে এমন লেখকের সংখ্যা খুব অল্প, যারা সম্মানীকে নিজের অধিকার বলে মনে করেন এবং সম্মানী ছাড়া কোথাও লিখতে চান না। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে লেখক সম্মানী বা রয়্যালটির চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অধিকাংশ দেশে লেখার জন্যে সম্মানী বা রয়্যালটি প্রাপ্তির নিশ্চয়তার কারণে লেখালেখি সফলভাবে পেশাদারিত্ব অর্জন করেছে। কেবল পেশাদারিত্বই নয়, অনেক লেখক লেখালেখি করে বিশে^র শীর্ষ ধনীদের তালিকায় নিজের নামও যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
বাংলাদেশে এমন ভাবনা এখনও স্বপ্নের পর্যায়ে আসেনি। লেখার উপার্জনে দেশের শীর্ষ ধনী হওয়া তো নয়ই, সচ্ছলভাবে চলার বিষয়টিও এখানে নির্মম বাস্তবতা মাত্র।
বিশে^র শীর্ষ আয়ের লেখকদের মধ্যে জে কে রাউলিং অন্যতম। ২০১৬ সালে তাঁর আয় ছিলো ৯৫ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রায় ৭৬০ কোটি টাকা। এ আয়ের সিংহভাগ এসেছে তাঁর বইগুলোর প্রিন্ট ও ই-বুক সংস্করণের রয়্যালটি থেকে।
তিনি প্রথম লেখক, যিনি বই লিখে বিলিয়নিয়ার হয়েছেন। শূন্য থেকে একজন মানুষ সাহিত্য চর্চা করে কীভাবে শীর্ষ নারী ধনীদের অন্যতম হতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণও জে কে রাউলিং। তিনি বিবাহ বিচ্ছেদের পর আর্থিক অনটনে ভুগেছিলেন। সন্তানের পড়ার খরচ জোগাতেও তিনি হিমশিম খেতেন।
জীবিকা হিসেবে রাউলিং সেসময় শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু অভাব-অনটনেও সাহিত্য চর্চা বন্ধ করেননি। ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ লেখার পরে তিনি কেবল রাতারাতি বিখ্যাতই হননি, পাশাপাশি রয়্যালটির অর্থে তাঁর জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে দারিদ্রতার অভিঘাত।
অন্যদিকে ২০১৬ সালের ফোর্বস ম্যাগাজিনে বিশে^র সেরা ধনী লেখকদের তালিকায় ছিলেন পলা হকিন্স। জিম্বাবুয়ে জন্ম নেয়া হকিন্স এক বছরে লেখালেখি থেকে ১ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করেন। ‘দি গার্ল অন দ্যা ট্রেন’ উপন্যাসটি তাঁর আলোচিত সাহিত্যকর্ম।
অথচ রাউলিংয়ের মতো তাঁকেও দারিদ্রপীড়নে ভুগতে হয়েছিলো। তিনি গার্ডিয়ানকে এ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জীবন ও আর্থিক অবস্থা নিয়ে আমি খুব উদ্বেগে ছিলাম। এখন আমি মুক্ত। এখন আমি কিছু করতে পেরেছি।’
জেমস প্যাটারসন, ড্যান ব্রাউন, জেফ কিনেরি প্রমুখরা কেবল রয়্যালটির অর্থেই বছরের কয়েকশ’ কোটি টাকা উপার্জন করেন। বিখ্যাত লেখক হার্পার লির উপন্যাস ‘দু কিল অ্যা মকিংবার্ড’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রতিবছর এ বইয়ের জন্য ৫০ লাখ ডলার রয়্যালটি পেতেন। রয়্যালটি প্রাপ্তির এমন বিস্মিত করা নজির আরো অনেক রয়েছে।
বহির্বিশে^ ভালো লিখে ভালো লেখক সম্মানী পাওয়ার দৃষ্টান্ত থাকলেও আমাদের অনেক বিখ্যাত লেখককেই অর্থকষ্টে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিলো। তাঁর বইও পাঠক মহলে চলতো খুব। তাঁর বই প্রকাশ করে প্রকাশকরা আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠলেও নজরুলের কোনো উন্নতি হয়নি। তাঁর সংসারের অনটনের কথা সর্বজনবিদিত হয়ে আছে।
আরো বেদনার বিষয় হলো, অর্থাভাবে তাঁর সঠিক চিকিৎসা পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। বাঁধনহারা কবি সম্মানীর অর্থের জন্য পত্রিকা অফিস অফিসে ঘুরেছেন। প্রকাশকরাও তাঁর প্রাপ্য রয়্যালটি থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছে। অনিশ্চিত জীবিকার কারণে জীবনানন্দ দাশের আর্থিক অসচ্ছলতার কথাও আমাদের অজানা নয়।
আজ তাঁর যে বিপুল গদ্যসত্তার দৃষ্টান্ত আমরা দেখি, গবেষকরা মনে করেন লেখক সম্মানীর জন্য জীবনানন্দ গদ্য লেখা শুরু করেছিলেন। কারণ, কবিতার চেয়ে গদ্যে সম্মানী বেশি পাওয়া যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবিত অবস্থায় খ্যাতি শীর্ষে থাকলেও বিত্তের স্পর্শ পাননি।
দারিদ্র্যের কারণে তিনি স্ত্রীর গহনা বন্ধক রেখেছিলেন, বাসাভাড়া বাকি, সেজন্য বাড়ির মালিক তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলো। নজরুলের মতো তাঁরও চিকিৎসা করার মতো অর্থ ছিলো না। ১৯৫৬ সালের ৩১ জুলাই মানিক তাঁর ডায়েরিতে লিখেন : ‘কদিন থেকে শরীর খুব খারাপ… কী যে দুর্ব্বল বলা যায় নাÑবিছানা থেকে উঠবারও যে শক্তি নেইÑ এদিকে ঘরে পয়সা নেইÑজোর করে তো বেরোলাম ফিরব কি না না জেনে।’ জীবতাবস্থায় কিংবদন্তীতুল্য লেখক হয়েও মানিকের জীবনে আর্থিক স্বচ্ছলতা আসেনি।
শিল্পের সফলতার চূড়ায় থেকেও আর্থিক দিক দিয়ে তিনি ততটায় নি¤œগামী ছিলেন। তাঁর শেষ জীবনের উপলব্ধি ছিল এমন : ‘ ‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’ কারণ তিনি জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন যতই ভালো লেখা হোক, লেখালেখি এদেশে পেশা হিসেবে দাঁড়ায়নি।
লেখার পারিশ্রমিকে জীবন চলে না। অথচ স্বাভাবিকভাবে মানিকের লেখার যে শিল্পমূল্য ও জনপ্রিয়তা ছিলো, তাঁর ন্যূনতম পারিশ্রমিকও তিনি পাননি। সম্মানী বঞ্চিত মানিককে অল্পবয়সেই চলে যেতে হলো। এমন উদাহরণ ও দুঃসহ জীবনের গল্প আরো অনেক রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখার জন্য সম্মানী নিতেন। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন তাঁর কাছে লেখা চাইতে গেলে তিনি লেখক সম্মানীর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ লেখক সম্মানী নিজের জন্য নিতেন না, সম্মানী থেকে প্রাপ্ত অর্থ শান্তিনিকেতনের কাজে লাগাতেন।
তবে রবীন্দ্রনাথের রয়্যালটি নিয়ে একটি অন্যরকম গল্পও রয়েছে। ১৯২০ সালে দিকে জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথের বই কয়েক লাখ কপি বিক্রি হয়েছিলো। কবির রয়্যালটির কয়েক মিলিয়ন মার্ক জমা হয়েছিলো ব্যাংকে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানালেন, যুদ্ধের কারণে মার্কের দাম দ্রুত কমে যাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ যখন জার্মানিতে পৌঁছলেন তখন মিলিয়ন মার্কের মূল্য এসে ঠেকেছে দশ হাজার রুপি সমতুল্যে! সাশ্রয় করতে বন্ধুদের উপদেশে রবীন্দ্রনাথ ব্যাভারিয়ান বন্ড কিনতে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ততক্ষণে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানালো, মুদ্রার মান কমে যাওয়াতে কবির অ্যাকাউন্টে এখন সামান্য কিছু অর্থ রয়েছে। তারা সেজন্যে অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন! রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বাবা একবার কোটিপতি হয়েই গিয়েছিলেন!’
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছিলো। হঠাৎ তাঁর বাড়িতে এসে হাজির শনিবারের সজনীকান্ত দাস। তিনি বিভূতির হাতে নব্বই টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘পথের পাঁচালী’ বই আকারে আমি ছাপব! নব্বই টাকা পেয়ে বিভূতিভূষণ ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, জসীম উদ্দীন, শওকত ওসমানও লেখক রয়্যালটির উপর গুরুত্ব দিতেন।
বিখ্যাত ছড়াকার সুকুমার বড়–য়ার প্রথম বই ছিলো ‘পাগলা ঘোড়া’। ১৯৬৫ সালের ঘটনা। তিনি বইটির জন্য অগ্রিম সম্মানী পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্যে, ‘লুৎফুর হায়দার চৌধুরী তখন বাংলা একাডেমির সাংস্কৃতিক বিভাগের প্রধান।
তিনি কতগুলো ছড়া মার্কিং করে দিয়ে বললেন,আপনাকে সাড়ে তিনশ’ টাকা দেয়া হবে। তারপর বই ছাপা হবে।’ সুকুমার বড়–য়া খুশি না হয়ে পারেননি। এত টাকা! তখন স্বর্ণের ভরি ছিলো ১৩০ টাকা। সম্মানীর টাকায় সুকুমার নিজের জন্য আংটি, তাঁর স্ত্রীর জন্যে আংটি ও কানের দুল কিনেছিলেন। এখনও বাঁ হাতে সেই আংটি তিনি পরেন। এটি যেমন আনন্দের বিষয়, তেমনি বেদনার বিষয়ও আছে অনেক। সুকুমার বড়–য়া প্রথম গ্রন্থের রয়্যালটি পেলেও তিনি অন্য বইগুলোর রয়্যালটি তেমন পাননি।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমার মোট বইয়ের সংখ্যা ২২টি। কিছু বইয়ের রয়ালিটি পেয়েছি। বাংলাবাজারের প্রকাশকরা একটি পয়সাও দেয়নি। ‘চিচিংফাঁক’ বাদে আর কোনো বইতে কোনো টাকা পাইনি। যুক্তাক্ষর ছাড়াও ছড়ার বই আছে। লেখার সময় অত খেয়াল করিনি, পরে দেখি, হয়ে গেছে।
তবে প্রকাশক টাকা দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো কপিও দেয়নি।’ কেবল সুকুমার নন, আবুল হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হকসহ অনেক বরেণ্যের বইয়ের রয়্যালটি প্রাপ্তি নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেখানে প্রবীণদের লেখক সম্মানীর এমন অবস্থা, সেখানে তরুণ লেখকদের পরিণতি সহজেই অনুমেয়।
লেখালেখি বিভিন্ন দেশে যেভাবে পেশা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, এ উপমহাদেশে এখনো সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। যদি লেখালেখিতে পেশাদারিত্বের জায়গা সম্পূর্ণ থাকতো তবে নজরুল-জীবনানন্দ-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়রা কেবল রয়্যালটির অর্থের স্বাচ্ছন্দে জীবন পার করতে পারতেন। তাদের জীবন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যেত না।
বছরে বছরে সময় অনেক বদলে গেছে, পৃথিবী ছুটে গেছে উৎকর্ষের দিকে। কিন্তু রয়্যালটি প্রদানের ক্ষেত্রে ওইভাবে দৃশ্যের পরিবর্তন হয়নি। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে বাংলাদেশে লেখক সম্মানী ও রয়্যালটি প্রদান অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি। নবীন লেখকরা নিজেরাই কিছু লেখার পর তা প্রকাশের জন্যে তীব্রভাবে মরিয়া হয়ে উঠেন।
অধিকাংশ সময়ই তারা প্রকাশককে বই প্রকাশের জন্য নগদ অর্থ দিয়ে থাকেন। চঞ্চল আশরাফ লিখেছেন, এদেশে প্রকাশককে রয়্যালটি দেয় লেখকরা! অর্থপ্রাপ্তির কারণে এ দেশের বেশিরভাগ প্রকাশক বই প্রকাশের জন্যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। সে কারণে লেখক ও প্রকাশক দুজনের কাছেই লেখার মানের প্রশ্নটি আর মুখ্য থাকে না।
অথচ জে কে রাউলিংয়ের ‘হ্যারি পটার’ পা-ুলিপি প্রথমবার আটজন প্রকাশক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে স্টিফেন কিং প্রকাশকের কাছে ধরণা দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে পা-ুলিপি ডাস্টবিনে পর্যন্ত ফেলে ছিলেন। রাউলিং কিংবা কিংয়ের লেখার মান নিয়ে প্রকাশকরা সন্দিহান ছিলেন। সেজন্য বই দুটি তারা ছাপতে চাননি। আটবার আটজন প্রকাশকের দ্বারে ঘুরেও রাউলিং প্রকাশককে অর্থ দিয়ে বই করতে যাননি।
অন্যদিকে প্রকাশকরাও স্টিফেন কিংয়ের কাছে বই প্রকাশের জন্যে অর্থ চায়নি। লেখক ও প্রকাশকের এমন মানসিকতা আমাদের দেশে ভাবা যায় না। যেখানে বিপুল সংখ্যক লেখক প্রকাশককে বই প্রকাশের জন্য উল্টো টাকা দেয় সেখানে রয়্যালটির প্রশ্ন গৌণ হয়ে যায়।
অন্যদিকে খুব অল্প সংখ্যক প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা লেখক সম্মানী দিয়ে থাকে। আক্ষেপের বিষয় হলো, অনেক বিখ্যাত দৈনিকও লেখকের পাপ্যটুকু তাদের দিতে অপরাগ। ফলে পত্রিকা লেখা ও বই প্রকাশÑদুটি মাধ্যম থেকেই সম্মানীবঞ্চিত হচ্ছে লেখকরা।
বাংলাদেশে বর্তমানে যারা ভালো লিখেন, তারাও সমকালীন ¯্রােতে থেকে উপযুক্ত রয়্যালটি পান না। বই প্রকাশের পর লেখকরা রয়্যালটির জন্যে প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। প্রকাশকও ‘কাল আসুন’, ‘বই বিক্রি নেই’ ইত্যাদি কথা আওড়িয়ে লেখককে বিদায় করতে চান।
হুমায়ূন আহমেদ বা ইমদাদুল হক মিলনও প্রথম জীবনে এমন অভিজ্ঞতার শিকার হন। প্রকাশকদের কাছে রয়্যালটির টাকার জন্যে তারা দুজন বাংলাবাজারে বহুবার হানা দিয়েছিলেন। ইমদাদুল হক মিলনের মনে হয়েছিল লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেয়াটা ছিল প্রায় আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত।
এ দুজন লেখক পরবর্তীতে কেবল প্রকাশকদের কাছ থেকে লেখকের প্রাপ্য পারিশ্রমিকই আদায় করেননি, তাঁরা অন্য লেখকদের জন্যেও সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। ১৯৯২-৯৩ সালে চার যুবক নতুন বই আনতে হুমায়ূন আহমেদের বাসায় গিয়েছিল।
তাদের এড়ানোর জন্য হুমায়ূন বললেন, ‘একটা বইয়ের জন্য আমাকে ১০ লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হবে।’ তাঁর কথা শুনে যুবকরা নিঃশব্দে চলে গেলে হুমায়ূন ভাবলেন আপদ বিদায় হয়েছে। পরদিন যুবকরা কিন্তু আবার এলো। সাথে চটের একটি ব্যাগ। তারা হুমায়ূন আহমেদের ‘সামনে গিয়ে ব্যাগটা উপুড় করে দিলেন, ‘স্যার, এই যে ১০ লাখ টাকা। বই দেবেন কবে?’ হুমায়ূন আহমেদ এমন অগ্রিম প্রাপ্তির কথা ভাবতে পারেননি। বিশেষত তাঁর হাত ধরেই বইয়ের রয়্যালটির অর্থের পরিমাণ ভিন্ন উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছে।
বাংলা একাডেমির হিসেব মতে, ২০১৮ সালের বইমেলায় ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। যদি বই বিক্রির ১৫ ভাগও লেখকরা রয়্যালটি পান তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশে সবমিলিয়ে যদি বইমেলায় ১ হাজার লেখকের বই প্রকাশ হয়, তবে প্রত্যেক লেখকই গড়ে ১০ হাজার টাকা রয়্যালটি পাওয়ার কথা। সেটা যে লেখকরা পায়নি, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
প্রকাশকদেরও রয়্যালটি নিয়ে নিজস্ব অভিমত রয়েছে। তারা বলছেন, প্রকাশনা সংস্থা এখনও শিল্প হিসেবে দাঁড়ায়নি। অনেক বই মানহীন বলে বিক্রি হয় না। সেজন্য অনেকই রয়্যালটি দেয়া সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশে প্রকাশনা আইন থাকলেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। অধিকাংশ প্রকাশনীর সম্পাদনা বোর্ড নেই। বইবিক্রির হিসেবও প্রকাশকরা লেখকদের দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। অনেক লেখক বই করার সময় প্রকাশকের সাথে কোনো চুক্তি করেন না। ফলে প্রকাশকও সুযোগ পায়।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেও কয়েকটি প্রকাশনী লেখককে উপযুক্ত রয়্যালটি দিয়ে যাচ্ছে। তারা বইয়ের হিসেবসহ নির্দিষ্ট সময়ে রয়্যালটির অর্থ লেখককে পৌঁছে দিচ্ছে। প্রকাশনা ও লেখালেখিকে পেশা হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য যৌথভূমিকার প্রয়োজন। প্রকাশক যেমন মানসম্মত বই প্রকাশের পর লেখককে উপযুক্ত সম্মানী দিবেন, তেমনি লেখকরা মানসম্মত লেখা প্রকাশককে দিয়ে ন্যায্য রয়্যালটি বুঝে নিবেন।
এজন্য লেখক-প্রকাশকের মধ্যে চুক্তি, স্বচ্ছতা ও পেশাদারী মনোভাব থাকতে হবে। এতে পাঠকরা উপকৃত হবেন এবং বই বিক্রি বৃদ্ধি পাবে। লেখকের জন্য পাপ্য রয়্যালটি ও সম্মানী নিশ্চিত করা হলেই অদূর ভবিষ্যতে লেখালেখি পেশা প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক- মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
কবি ও সাহিত্যিক