উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ত্রাণ হিসেবে পাওয়া চালের বস্তা নিয়ে জড়ো হয়েছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা পুরুষ। জটলার মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়ে ১০-১২ বছর বয়সী এক শিশু। শিশুটি বোধহয় ত্রাণ চুরি করতে এসেছে-এই ভাবনা থেকে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে জটলা থেকে বের করে দেওয়ার উপক্রম হয়।
হঠাৎ শিশুটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আর কাতর কণ্ঠে তার বলতে থাকে, ‘আঁই চোর ন, আঁর বাপরে তোয়াইরদি। আঁর ছোড ভাইয়রে হাটি ফালাইয়্যি। আঁর বাপ বরমারতুন আইত পাইরগ্যি কি না ন জানি। আইঁ তোয়াই চাইরদি।’ (আমি চোর নই, আমার বাবাকে খুঁজছি। আমার ছোট ভাইটাকে কেটে ফেলেছে। আমার বাবা বার্মা থেকে আসতে পেরেছে কি না জানি না। আমি খুঁজে দেখছি। )
সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) উখিয়ার কুতুপালংয়ের আমতল এলাকায় চোখে পড়ে শিশুটির এমন আহাজারি।
কথা হয় ফরিদ উল্লাহ নামের শিশুটির সঙ্গে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার ওয়াইব্যাক গ্রামের হাফেজ সৈয়দ আলমের ছেলে সে। ১৫ দিন আগে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে মা, ভাইবোনদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফরিদ।
মিয়ানমারে ফরিদের চোখের সামনে তার পাঁচ বছরের ছোট ভাইকে কেটে ফেলেছে সেনাবাহিনী।
নৃশংস এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করা ফরিদ মা, ভাই-বোনদের নিয়ে পালাতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার ৬০ বছরের বৃদ্ধ বাবাকে। বাবাও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কিংবা মগদের হাতে প্রাণ দিয়েছে কি না জানে না ফরিদ। তবে তার বিশ্বাস, বাবা বেঁচে আছেন। পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
আর তাই ফরিদ এখন ক্যাম্পে আর জটলায় খুঁজে ফিরছে বাবাকে। খুঁজতে গিয়ে চোখের সামনে নিজের ভাইয়ের বয়সী কাউকে দেখলে আটকাতে পারে না চোখের পানি।
ফরিদ জানায়, তার বাবা কোরআনের হাফেজ। মাদ্রাসা শিক্ষক। সেও কোরআনের ১৫ পারা শেষ করেছে। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ভাই আকরাম উল্লাহকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কেটে ফেলেছে।
বাবা মাদ্রাসায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা ভাইবোনেরা সবাই মাদ্রাসায় যাবার জন্য বেরিয়ে পড়ে। হঠাৎ সেনাবাহিনী পাড়ায় আক্রমণ করে।
‘গুলি আর গুলি। শুধু গুলি করছে। আর কেউ কেউ বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। দৌড়াদৌড়ি শুরু হল। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। আমরা দৌড়ে ঘরে চলে যাই। ছোট ভাই আকরাম সেনাবাহিনীর সামনে পড়ে যায়। দেখলাম, তাকে প্রথমে লাথি দিয়ে ফেলে দিল। তারপর কুপিয়ে মারল।’
ছেলের রক্তাক্ত মরদেহ ফেলেই হাফেজ সৈয়দ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে কাছে একটি পাহাড়ে আশ্রয় নেন। সেখানে ওই গ্রামের প্রায় ১৫০ পরিবার আশ্রয় নেয়। রাতে সেখানেও আক্রমণ চালায় সেনাবাহিনী আর মগরা। রাতেই সবাই মিলে সীমান্তের দিকে পালানোর সময়ও পেছন থেকে গুলি করছিল সেনাবাহিনী।
চারদিন হেঁটে তারা নাফ নদীর কাছে পৌঁছান। পালাতে থাকা মানুষের ভিড়ে হাফেজ সৈয়দ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
ফরিদ বাংলানিউজকে বলে, আমার মনে হচ্ছে আব্বা বেঁচে আছেন। তিনিও আমাদের খুঁজছেন। বালুখালী, কুতুপালং, থাইংখালী, টেকনাফের উনচিপ্রাং সহ প্রায় সব অস্থায়ী ক্যাম্পেই ফরিদ তার বাবাকে খুঁজতে গিয়েছিল বলেও জানায়।
এক কাপড়ে চলে আসা ফরিদের ঘরেও ক্ষুধার কান্না। থাইংখালীতে একটি মাদ্রাসার পাশে ত্রিপল টেনে তারা থাকছে। ঘরে মা অসুস্থ। অন্য ভাইবোনরা ত্রাণ খুঁজে আর ফরিদ খুঁজে বাবাকে।
‘কিছুই আনতে পারিনি। প্রথমে দুদিন একেবারে না খেয়েই ছিলাম। এখন বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি যা-ই ত্রাণ হিসেবে পাচ্ছি সেটা সবাই মিলে খাচ্ছি। তবে চাল না পাওয়ায় ভাত খেতে পারছি না। গত দুদিনে মাত্র একবেলা ভাত খেয়েছি।’ বলে ফরিদ
ফরিদ নামের এই শিশুটি ভাইকে হারিয়েছে চিরতরে। বাবাকে আর খুঁজে পাবে কিনা তাও জানে না। বাড়ি-ঘর সব হারিয়ে সে এখন ভিনদেশে। তার পরিচয় এখন শরণার্থী।
শুধু ফরিদ নয়, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে ভিটেমাটি আর স্বজন হারানোর দীর্ঘশ্বাস এখন অনুপ্রবেশকারী প্রায় সকল রোহিঙ্গা পরিবারের। দিন যতই যাচ্ছে, দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ হচ্ছে। কোনমতে মাথা গোঁজা আর খাওয়া মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পর এখন তাদের বুকে ঘরবাড়ি-স্বজন হারানোর গভীর বেদনা। (বাংলানিউজ)
নিউজ ডেস্ক
: : আপডেট, বাংলাদেশ ৬: ০৩ পিএম, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ মঙ্গলবার
ডিএইচ