বাংলাদেশে চাঁদ দেখা হয় যেভাবে
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর দিন-তারিখ চূড়ান্ত হয়। সাধারণত আরবি মাসের ২৯ তারিখের দিন বিকেলে এ কমিটি বৈঠকে বসে। সেদিন যদি দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যায়, তাহলে পরদিন রোজা, ঈদ, কোরবানি ইত্যাদির ঘোষণা দেয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন। আর তা না হলে ৩০ দিন শেষেই নতুন তারিখ চূড়ান্ত হয়।
চাঁদ দেখা কমিটি যেভাবে কাজ করে
চাঁদ দেখার সংবাদ নিশ্চিত করার জন্য ঢাকায় ধর্মমন্ত্রীর নেতৃত্বে বৈঠকে বসেন চাঁদ দেখা কমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া মূল চাঁদ দেখা কমিটির সঙ্গে একযোগে প্রতিটি জেলায় একটি করে কমিটি কাজ করে। দেশের কোথাও চাঁদ দেখা গেলে সেটি স্থানীয় প্রশাসন বা ইসলামিক ফাউন্ডেশনসংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে জেলা কমিটির কাছে পৌঁছানো হয়। পরে জেলা প্রশাসন দ্রুত সেটি নিশ্চিত করে। স্থানীয় অনেকে চাঁদ দেখেছে কি না কিংবা স্থিরচিত্র বা ভিডিও চিত্র এসব দ্রুত সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয়ে থাকে স্থানীয় প্রশাসন।
অন্যদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেশজুড়ে যে ৭৪টি স্টেশন আছে, সেখান থেকেও তথ্য নেয় চাঁদ দেখা কমিটি। যদি আবহাওয়া অনুকূল না থাকে অর্থাৎ খালি চোখে চাঁদ দেখার সুযোগ না থাকলে আবহাওয়া স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যও চাঁদ দেশের আকাশে উঠেছে কি না তা নিশ্চিত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নতুন চাঁদ সম্পর্কে কোরআন-হাদিসের ভাষ্য
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘লোকেরা আপনাকে নতুন মাসের চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদের বলে দিন, এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজকর্মের) এবং হজের সময় নির্ধারণ করার জন্য।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৯)
হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা শুরু করো এবং সেটা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা ছেড়ে দাও।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০৯; মুসলিম, হাদিস : ১০৮১)
অন্য বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা (নতুন চাঁদ) না দেখা পর্যন্ত রোজা রেখো না এবং তা (নতুন চাঁদ) না দেখা পর্যন্ত রোজা ছেড়ে দিয়ো না।’ (মুআত্তা মালিক, হাদিস : ৬৩৫)
শাবানের চাঁদ দেখার সরকারি সিদ্ধান্ত
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভাপতি শেখ মো. আব্দুল্লাহর সভাপতিত্বে গত শনিবার (৬ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত সভায় চাঁদ দেখা যায়নি বলে সিদ্ধান্ত জানানো হয়। সেদিন সন্ধ্যার পর সেখানেই জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় আগামী ২১ এপ্রিল রাতে শবেবরাত পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
খাগড়াছড়িতে চাঁদ দেখার দাবি
চাঁদ দেখার ও শবেবরাত সম্পর্কে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এমন সিদ্ধান্তের পর কেউ কেউ সিদ্ধান্তটি সঠিক নয় বলে দাবি করেন। বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) ‘মজলিসু রুইয়াতুল হিলাল’ নামের একটি সংগঠনের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, গত ৬ এপ্রিল শাবানের চাঁদ দেখা গেছে এবং সে বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করা হলেও সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়নি।
তারা দাবি করেন, ৬ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে চাঁদ দেখার পর অনেকে জেলা প্রশাসককে ফোনে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ডিসি সাহেব ফোনে বলেন, ‘চাঁদ দেখার ঘোষণা হয়ে গেছে, চুপ করে যান।’ বলেন রুহুল হাসান। ওই দিন ‘চাঁদ দেখার’ বিষয়টি পর্যালোচনা না করে তড়িঘড়ি করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন তাঁরা। অন্যদিকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকেও কয়েকজন চাঁদ দেখার দাবি করে।
‘বিভ্রান্তি’ কাটাতে আজ চাঁদ দেখা কমিটির বৈঠক
শবেবরাতের ‘ভুল’ তারিখ ঘোষণার অভিযোগে শাবান মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে ‘জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ায়’ আজ সকালে জরুরি সভায় বসছে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। গত সভায় যাঁরা চাঁদ দেখেছেন বলে দাবি করেছেন, তাঁদেরও এ বৈঠকে থাকতে বলা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বায়তুল মোকাররম সভাকক্ষে এই সভা হবে বলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
যড়যন্ত্র ও বিভ্রান্তি তৈরির ‘অভিযোগ’ করছেন অনেকে
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যাঁরা খাগড়াছড়ি ও বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে চাঁদ দেখা গেছে বলে দাবি করছেন, তাঁরা মূলত আলোচনায় আসার জন্য এবং নিজেদের পরিচিত করার জন্য এমন দাবি করছেন। না হয় ওই দিন ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা সার্বিক খবরাখবর নিয়ে এবং সব দিক বিবেচনা করে নিশ্চিত হওয়ার পরই শাবান মাস ও পবিত্র শবেবরাতের ঘোষণা দেন।’
ইসলামের যাবতীয় বিধান চাঁদ দেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত। চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়ত নির্দেশিত সাক্ষীর কথা গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু কখনো কখনো আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে চাঁদ দেখা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এবার বাংলাদেশেও শাবান মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে বিশিষ্টজনের মতামত নিয়েছেন কাসেম শরীফ
পুনরায় পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে: ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ
শাবান মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, এ বিষয়ে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ বলেন, এর মধ্যে আমরা পুনরায় পর্যালোচনার জন্য দেশের বিশিষ্ট আলেম, আবহাওয়াবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মিটিং ডেকেছি। মিটিংয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আগের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি জানেন যে আমাদের প্রতি জেলায়ই চাঁদ দেখা কমিটি আছে। এবং প্রতি জেলার বড় বড় মসজিদ, কওমি ও সরকারি মাদরাসার প্রিন্সিপালদের নিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমরা আগে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা তাঁদের পাঠানো তথ্য মতেই নিয়েছি। এখন যেহেতু কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছে, তাহলে পুনঃ পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সৌদি আরব ও ভারতের সঙ্গে এবার বড় ধরনের ব্যবধান: মুফতি এমামুল হক কাসেমি
চাঁদ দেখা কমিটির সদস্য ও ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরার মুফতি এমামুল হক কাসেমি কালের কণ্ঠ’কে বলেন, এবার শাবান মাসের চাঁদ দেখার বিষয়টি এ জন্য পুনরায় বিবেচনা করা দরকার যে এবার সৌদি ও ভারতের সঙ্গে আমাদের বড় ধরনের ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরবে শুক্রবার (৫ এপ্রিল) এবং ভারতে শনিবার (৬ এপ্রিল) চাঁদ দেখা গেছে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের বিশেষত কলকাতার সঙ্গে আমাদের দূরত্ব হওয়ার কথা নয়। ভারতের সঙ্গে আমাদের অর্ধ ঘণ্টার দূরত্ব। অর্ধ ঘণ্টার দূরত্বে চাঁদের উদয়স্থানের তারতম্য হয় না। প্রথম দিনের চাঁদ উঠার পর নির্দিষ্ট স্থানে ৫০ মিনিট থাকে। তাই বিষয়গুলো সামনে রেখে পুনরায় বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। অতীতেও এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পর পুনরায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছিল। ইসলামী শরিয়ত নির্দেশিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ এখনো আছে।
এখনো পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে: মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ
শায়খ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ কালের কণ্ঠ’কে বলেন, শাবানের চাঁদ নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তা মীমাংসার সময় শেষ হয়ে যায়নি। এ বিষয়ে আজ বৈঠক ডাকা হয়েছে। আমিও সেখানে থাকব। তবে দাবিটি কাদের বা কোন পক্ষের—সেটি বিবেচ্য নয়। ইসলামী শরিয়ত নির্দেশিত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ আছে।
ইসলাম ডেস্ক