রাজনীতি

নির্বাচনে যেতে চায় বিএনপি,প্রস্ত্তত আওয়ামী লীগ !

কার অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে, এ নিয়ে প্রধান দুই দলের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে। অন্যদিকে বিএনপি আগের নমনীয় অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে এখন বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে দলটি নির্বাচনে যাবে না।
তবে আওয়ামী লীগ মনে করে, বিএনপি যত গরম কথাই বলুক না কেন, বিএনপি এবার নির্বাচন বর্জন করবে না। এ কারণেই তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের কথা ভেবে বর্তমান সাংসদদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের পাশাপাশি তৃণমূলে দলীয় কোন্দল কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপি প্রকাশ্যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বললেও ভেতরে-ভেতরে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি, সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজ করছে। পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ক্ষমতাবলয়ের বাইরের রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা শুরু করেছে। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত দলের বাইরে থাকা নেতাদের আবার দলে ফিরিয়ে আনার প্রয়াসও চলছে।

দুই দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ যেমন ২০১৪ সালের মতো একটি একতরফা নির্বাচন করতে চায় না, তেমনি বিএনপিও নির্বাচন বর্জনের কথা ভাবছে না।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এই ব্যাপারে অনড় অবস্থানেই আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এই বিষয়ে ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কোনো সমঝোতায় যাবে না সরকারি দল। উল্টো বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলার মাধ্যমে দলটিকে চাপে রেখে নির্বাচনে নিয়ে আসতে চায়।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একটি সূত্র জানায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে—এটা ধরে নিয়েই প্রস্তুতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে দলে বিভক্তি এড়াতে ছোটখাটো অপরাধে তৃণমূলের কাউকে দল থেকে বহিষ্কার না করা এবং কমিটি বিলুপ্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ-সংক্রান্ত চিঠি সব সাংগঠনিক জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে।

অবশ্য আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিনিধিকে বলেন, নির্বাচনের এখনো অনেক সময় বাকি আছে। এর মধ্যে রাজনীতিতে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। পরিস্থিতি দাবি করলে বিএনপিকে কিছু মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার মতো সমঝোতা হতেও পারে। সবকিছু নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান প্রতিনিধিকে বলেন, আওয়ামী লীগের অবস্থান আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে। তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না। তিনি বলেন, সংবিধানে বলা আছে, একটি নির্বাচনকালীন সরকার হবে। গত নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা বিএনপিকে কয়েকটি মন্ত্রণালয় দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। আগামীতেও শেখ হাসিনা চাইলে এমন প্রস্তাব দিতে পারেন।

২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর থেকেই বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। এ দাবি পূরণ না হওয়ায় ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দলটি। সে সময় বিএনপি আন্দোলন নিয়েই ছিল, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে প্রকাশ্য কোনো তৎপরতা ছিল না। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে পুরো দাবি আদায় করা সম্ভব নয় বলে বিএনপির শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেন। তাঁরা চান, সরকার কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করুক।

অবশ্য বিএনপি একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বললেও এখনো পর্যন্ত রূপরেখা চূড়ান্ত করেনি। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মনোভাব দেখেই এগোতে চায় বিএনপি।

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, দলের কার্যক্রমকে এখন মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তা হলো দল গোছানো, আন্দোলন কৌশল নির্ধারণ ও নির্বাচনী প্রস্তুতি।

বিএনপির নেতারা মনে করছেন, সরকার এখনো আগের অবস্থানে অনড়। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের দাবি তারা সহজে মেনে নেবে না। দাবি আদায়ে শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে রাজপথের আন্দোলনেই যেতে হবে। এ জন্য পর্যায়ক্রমে আন্দোলনে যাওয়ার চিন্তাও করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতিও এগিয়ে রাখতে চায় বিএনপি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রতিনিধিকে বলেন, জনগণের প্রত্যাশামতো নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়নি। এরপরের ইস্যু নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার। সরকার আলোচনার মাধ্যমে এই দাবি না মানলে বিএনপির আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক আলোচনা সভায় মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট নিরসন করতে চায়। তা সম্ভব না হলে আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। ভবিষ্যতে একদলীয় কোনো নির্বাচন বাংলাদেশের মাটিতে আর হবে না। সে ধরনের পরিকল্পনা কারও থাকলে তাঁরা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন আছেন। গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য বিএনপির আন্দোলনও চলবে, নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলবে।

বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, দলের জাতীয় কাউন্সিলের দিন বক্তৃতায় খালেদা জিয়া ‘ভিশন ২০৩০’ শিরোনামে যে রূপকল্পের কথা বলেছিলেন, তার ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচনের জন্য একটি ইশতেহার তৈরির কাজ চলছে। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো দলে একধরনের প্রস্তুতি সব সময়ই থাকে। বিএনপিতে প্রার্থী বাছাইয়ের এক ধরনের প্রাথমিক কাজ করা আছে।

বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, গত মাসে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং দল গোছানোর নির্দেশনা দেন। এরপর থেকে জেলা কমিটি পুনর্গঠনের কাজও আবার গতি পায়। গত সপ্তাহে দুটি জেলায় সম্মেলন হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির জেলা কমিটি পুনর্গঠনের সঙ্গে যুক্ত দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান প্রতিনিধিকে বলেন, এখন পর্যন্ত ৩৩টি জেলায় নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি ও নির্বাচন—এ দুটি বিষয় সামনে রেখে বিএনপি পুনর্গঠনের কাজ করছে। বিএনপি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। সে নির্বাচন যখনই হোক বিএনপি অংশ নেবে, সে জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতিও রাখতে হচ্ছে।

বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নির্বাচন সহায়ক সরকারের চেয়েও দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলাই বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতিমধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। তবে, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ মনে করেন, দুর্নীতির মামলায় সাজা হলেও খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন।

এদিকে কূটনৈতিক মহলও আগামী নির্বাচন যাতে সব দলের অংশগ্রহণে হয়, সে ব্যাপারে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে গতকাল ব্রিটিশ মন্ত্রী অলোক শর্মার সঙ্গে বৈঠকেও নির্বাচনের বিষয়টি এসেছে। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নও উভয় দলের কাছে একই বার্তা দিয়েছে।(প্রথমআলো)

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৯:১৫,এ.এম ,০৫ মার্চ ২০১৭,রবিবার
ইব্রাহীম জুয়েল

Share