আজ বৃহস্পতিবার ( ১৬ মে ) ৪৩ তম ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। ৪৩ বছর আগে আজকের এ দিনে ভারতের পানি আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলো সারাবিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত মজলুম মানুষের সংগ্রামী নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ফারাক্কা বাঁধের কি ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে তখন তিনি অনুধাবন করেছিলেন ৯৬ বছর বয়সি এ দুরদর্শী মজলুম জননেতা।
লাখো মানুষের কাফেলাকে সাথে নিয়ে তিনি গর্জে উঠেছিলেন । মুহুমুহু শ্লোগানের মধ্যদিয়ে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন-মরণবাঁধ ফারাক্কা ভেঙ্গে দাও,গুড়িয়ে দাও। গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দাও। গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দাও বলে শ্লোগান নিয়ে লংমার্চের মাধ্যমে যে আওয়াজ তিনি তুলেছিলেন তা আজো যেন আন্দোলিত করে এ দেশের আকাশ বাতাস। ধ্বণিত-প্রতিধ্বণিত হয় পদ্মার নিস্প্রাণ তরঙ্গে।
তাই আজ একই আওয়াজ উঠেছে নেপালের গন্ডাক থেকে ভারতের মালদা বিহার রাজ্যে। আওয়াজ উঠেছে নদীকে তার স্বাভাবিক প্রবাহে চলতে দাও। সব ব্যারেজ আর ক্যানেল অপসারণ করো। নদী বাঁচাও মানুষ বাঁচাও দেশ বাঁচাও। ভারত বাংলাদেশ সর্বত্র একই আওয়াজ।
ভারতের পানি আগ্রাসী নীতি বাংলাদেশের জীবন ও জীব-বৈচিত্র্যই শুধু ধ্বংস করেনি। বরং ধ্বংসের মুখে ফেলেছে আমাদের হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা কৃষি, শিল্প ও বনজ সম্পদ। এক ফারাক্কা দফা রফা করে দিয়েছে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের নদ নদীর অস্তিত্বকে। ঠেলে দিয়েছে মরুময়তার দিকে।
১৯৭৬ সালের মে মাসের সেই লং মার্চের পটভুমি ছিল বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রকৃতি-জীববৈচিত্র্য, কৃষি-মৎস্য-নৌযোগাযোগ তথা সার্বিক জীবন জীবীকার ওপর সর্বনাশা ফারাক্কা ব্যারেজের বিরূপ প্রভাবের। আসন্ন বিপর্যয়ের বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরে আর্ন্তজাতিক নদী পদ্মার পানির নায্য হিস্যার দাবিতে গর্জে ওঠেন মওলানা ভাসানী। ডাক দেন ফারাক্কা লংমার্চের। তার ডাকে সাড়াদিয়ে আওয়াজ ওঠে চলো চলো ফারাক্কা চল। মরণ বাঁধ ফারাক্কা ভেঙ্গে দাও, গুড়িয়ে দাও।
লং মার্চে যোগ দেবার জন্য সারা দেশ থেকে বিভিন্ন পথে সে সময় লাখো মানুষ জমায়েত হয়েছিল রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দানে। সেখানে তিল ধারণের জায়গা ছিলনা। মানুষ অবস্থান নিয়েছিল মাদরাসা ময়দানের আশেপাশে এলাকাজুড়ে। চারিদিকে ছিল লোকারণ্য।
পদ্মার তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দানে বিখ্যাত তালের টুপি সফেদ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরিহিত মওলানা ভাসানী লংমার্চ নিয়ে চাপাইনবাবগঞ্জ যাবার আগে স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে দশ মিনিটের এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন যা ছিল দিক নির্দেশক ও উদ্দীপক।
এরপর লাখো মানুষকে সাথে নিয়ে চাপাইনবাবগঞ্জের উদ্যেশ্যে যাত্রা করে লং মার্চ। রাজশাহী শহর পার হতে না হতে লং মার্চ পড়ে বিরূপ আবহাওয়ার মুখে। ঝড় বৃষ্টি আর খরতাপ মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলে কাফেলা। কোনো কিছুই কাফেলার যাত্রা রোধ করতে পারেনি। রাতে লংমার্চের মানুষের বহর থামে চাপাইনবাবগঞ্জে। রাতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর ফের সকালে যাত্রা। সব শ্রেণির মানুষের এমন স্বর্ত:স্ফুত অংশগ্রহণ আর কখনো হয়নি।
মাইলের পর মাইল আম বাগান পেরিয়ে ভারত সীমান্তের কাছাকাছি কানসাটে গিয়ে থামে কাফেলা । লংমার্চের নেতৃত্বদানকারী মজলুম জনতার কন্ঠস্বর মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত অথচ জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।
উল্লেখ্য, লংমার্চ যদি সীমান্ত অতিক্রম করে ফারাক্কা ব্যারেজ চলে আসে এমন শংকায় ভারত সীমান্তে প্রচুর সেনা মোতায়েন করা হয়। ফারাক্কা লংমার্চে লাখো মানুষের এমন স্বত:র্স্ফুত অংশগ্রহণ আর লক্ষকন্ঠের গগন বিদারী শ্লোগান ভারতীয়দের দু:চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল।
বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে আরেকবার দেখেছিল সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা দেশের মানুষ তাদের নায্য হিস্যা আদায়ের জন্য কেমন ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে পারে। ফারাক্কা লংমার্চের রেশ ধরে ফারাক্কা ইস্যুটি জাতিসংঘ পর্যন্ত গিয়েছিল।
১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪৮ তম অধিবেশনে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ত্রিশ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ পানির নায্য হিস্যাটুকু পায় নি। বরং পানি চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ ও সালিশী ব্যবস্থার কথা কৌশলে এড়িয়ে যাবার কারণে পানির নায্য হিস্যা না পেলেও বিশ্ব দরবারে (জাতিসংঘ) নালিশ জানানোর পথটি বন্ধ হয়ে যায়।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারতের পানি লুটেরারা তাদের পানি শোষন নীতিকে আরো অক্টোপাসের মত ভাটির দেশ বাংলাদেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। শুধু ফারাক্কা নয় অভিন্ন ৫৪টি নদীর সবক’টি স্বাভাবিক প্রবাহে বাধাগ্রস্ত করছে। ১৯৭৬ সালে দুরদর্শী নেতা মওলানা ভাসানী যে আওয়াজ তুলেছিলেন তা এখন বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও সিকিম সর্বত্র অনুরণিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের সমীক্ষার সময় (১৮৪১-১৯৪৬) নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলা হয়েছিল।
ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি করার সময় পশ্চিম বঙ্গের প্রধান প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য এর বিরোধিতা করে বিরূপ সমালোচনার শিকার হন। ভারত সব শংকাকে উপেক্ষা করে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করে। তারপরও গঙ্গাকে ঘিরে বাস্তবায়ন করে নানা প্রকল্প। পানির অভাবে ভাটির দেশ শুকিয়ে মরলেও তা আমলে নিতে নারাজ ভারতের পানি নীতিনির্ধারকরা।
তিস্তার ওপর গজলডোবা দিয়ে আরেক গজব চাপিয়ে দেয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। পানি নিয়ে ভারতের দাদাগীরিতে বাংলাদেশের কৃষি তথা পরিবেশের ওপর ভয়ংকর বিরূপ প্রভাবের আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের শংকা এমন অবস্থা চলতে থাকলে পানি ও নদী একেবারে হারিয়ে যাবে। যা ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি করবে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আঞ্চলিক ও আর্ন্তজাতিক পয্যায়ে সোচ্চার হতে হবে।
বার্তা কক্ষ
১৬ মে ২০১৯