৬ জঙ্গির পরিচয় সনাক্ত : স্বচ্ছল পরিবারে বিকৃত তারুণ্য

সচ্ছল পরিবারে বিকৃত তারুণ্য
♦ অনেক পরিবার আগেই জানত সন্তানরা জঙ্গিদের পথে যাচ্ছে
♦ রোহান আওয়ামী লীগ নেতার ও সামিহ তিতুমীর কলেজের অধ্যাপকের সন্তান
♦ অন্তত ৬ মাস ধরে তারা নিখোঁজ ছিল

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে হামলা চালানো সন্ত্রাসীদের মধ্যে নিহত ছয়জনের পরিচয় মিলেছে। তাদের মধ্যে পাঁচজনই সমাজের প্রভাবশালী উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান।

ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে তারা। কয়েকজন মাস ছয়েক আগেই বাড়ি ছেড়েছিল। তারা নিখোঁজ হওয়ার পর সন্তানদের বিপথে যাওয়ার আশঙ্কার কথা পুলিশকে লিখিতভাবে জানিয়েছিল কোনো কোনো পরিবার।

স্বজনরা অভিযোগ করছে, পুলিশ সে সময় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। নিলে হয়তো আজ এ পরিণতি দেখতে হতো না। সংশ্লিষ্ট পরিবার, পুলিশ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিহত ছয়জন হলো রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রায়হান মিনহাজ, আন্দালিব আহমেদ ও সাইফুল ইসলাম চৌকিদার।

তাদের মধ্যে রোববার রোহান ও মোবাশ্বেরের বাসায় গিয়ে তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিবেদকরা। অন্যদের স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোন ও ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে।

ছয়জনের মধ্যে নিবরাস ইসলাম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী, রোহান ইমতিয়াজ ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল স্কলাসটিকা থেকে পাস করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল।

মীর সামিহ মোবাশ্বের স্কলাসটিকায় পড়তো।

এ ছাড়া রায়হান মিনহাজ ও আন্দালিব আহমেদ মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে। তাদের বন্ধু ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। সাইফুলকে পুলিশ সন্ত্রাসী বললেও পরিবার দাবি করছে সে দেড় বছর ধরে হলি আর্টিজানে পাচক হিসেবে কর্মরত ছিল।

গত শুক্রবার রাতেই আর্টিজান বেকারিতে হামলার দায় স্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)।

গত শনিবার আইএসের মুখপত্র আমাক নিউজ পাঁচ যুবকের ছবি প্রকাশ করে। সে ছবি পরে প্রচার করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জঙ্গি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।

সেখানে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়—আবু উমর, আবু সালাম, আবু রহিম, আবু মুসলিম ও আবু মুহারিব। তবে শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত উদ্ধার অভিযান থান্ডার বোল্টে নিহত ছয় সন্ত্রাসীর নাম উল্লেখ করা হয়—আকাশ, বিকাশ, ডন, বাঁধন ও রিপন হিসেবে।

শনিবার রাতে এ পাঁচজনের লাশের ছবি প্রকাশ করে পুলিশ। সাইট ইন্টেলিজেন্সে পাঁচজনের ছবি প্রকাশের পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

এ সময় নিহত সন্ত্রাসীদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে থাকা ছবির সঙ্গে সাইট ইন্টেলিজেন্সে প্রকাশিত ছবি মিলিয়ে স্বজন, সহপাঠী ও বন্ধুরা তাদের শনাক্ত করে।

সাইট ইন্টেলিজেন্স ও পুলিশের প্রকাশ করা ছবির সঙ্গে ফেসবুকে পাওয়া ছবিরও মিল পাওয়া গেছে। অন্তত চারজনের চেহারার মিল রয়েছে। বাকি একজনের ছবি সাইট ইন্টেলিজেন্স বা পুলিশের প্রকাশ করা ছবির সঙ্গে অতটা মেলেনি।

শনিবারই পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক জানিয়েছিলেন, আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীরা পুলিশের তালিকাভুক্ত দেশীয় জঙ্গি। তাদের খোঁজা হচ্ছিল। ওরা নিখোঁজ ছিল।

খোঁজ পেতে দৌড়ঝাঁপ করেছে পরিবার : রোহান স্কলাসটিকা থেকে পাস করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে সবে ভর্তি হয়েছিল। তাদের বাসা ঢাকার লালমাটিয়ায়। পরিবারের দাবি, রোহান উগ্রপন্থায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে, তা শুরুতে তারা বুঝতে পারেনি।

গত ৩১ ডিসেম্বর বাসা থেকে চলে যায় রোহান। এরপর আর ফিরে আসেনি। ছেলেকে খুঁজে পেতে মোহাম্মদপুর থানায় জিডিও করেছিল পরিবার, যার নম্বর ২৮৯।

রোহানের বাবা এস এম ইমতিয়াজ খান বাবুল সদ্য বিলুপ্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক। রোহানের স্বজনরা জানিয়েছে, ছেলেকে ফিরে পেতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপিসহ সব জায়গায় ধরনা দিয়েছে তারা।

ইমতিয়াজ খান আশঙ্কা করেছিলেন, তাঁর ছেলে জঙ্গিবাদের পথ বেছে নিয়েছে। ছেলের উদ্দেশে গত ২১ জুন বাবা ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘বাবা, তুমি কোথায়? দোহাই তোমার ফিরে এসো?’

স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশ রোহানকে খুঁজে বের করেনি, উল্টো তার বাবাকে বলেছিল, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যেতে পারে, ফিরে আসবে।

পরিবারের দাবি, পুলিশ তৎপর হলে হয়তো রোহানকে ফিরে পাওয়া যেত। আর এত বড় নৃশংস ঘটনাও হয়তো ঠেকানো যেত। মীর সামিহ মোবাশ্বেরের বাবার নাম মীর হায়াত কবির। বনানী ডিওএইচএসের ৫ নম্বর রোডের একটি বাসায় থাকে তার পরিবার।

মোবাশ্বেরও পরিবারের সঙ্গে এই বাসায় থাকত। তারা দুই ভাই। বড় ছেলে কানাডার টরন্টোতে পড়াশোনা করেন। মোবাশ্বের স্কলাসটিকা থেকে সম্প্রতি ও-লেভেল সম্পন্ন করেছে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

এ ঘটনায় গুলশান থানায় জিডি করেছিলেন বাবা হায়াত কবির। ছেলেকে খুঁজে পেতে র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ছোটাছুটিও করেছিলেন তিনি। তবে ছেলেকে ফিরে পাননি।

শেষে গুলশানের ঘটনায় নিহত সন্ত্রাসীদের ছবি প্রকাশের পর তাঁরা ছেলেকে চিনতে পারেন। জানা গেছে, ও লেভেল শেষ করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল মোবাশ্বের। ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান নিবরাস ইসলাম গত জানুয়ারিতে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। বন্ধুরা জানিয়েছে, নিবরাস যে মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করত সেটি বন্ধ ছিল। তবে সে ফেসবুক ব্যবহার করত। বন্ধুরা ফেসবুকের ইনবক্সে বার্তা পাঠিয়ে তাকে বাড়ি ফিরে আসতে অনুরোধ করেছিল, অন্তত মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিল। তার জন্য মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলেও বন্ধুরা তাকে জানিয়েছিল।

তবে এসবের কোনো কিছুকেই আমলে নেয়নি নিবরাস। বন্ধুদের দাবি, সে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। গুলশানের হামলায় নিহত সন্ত্রাসীদের ছবি প্রকাশের পর নিবরাসকে চিহ্নিত করে পরিচিতরা। জানা গেছে, নিবরাস প্রথমে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।

এর এক বছর পর কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তে চলে যায় মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে এক বছর পর ফিরে এসে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএতে ভর্তি হয়। বন্ধুরা জানিয়েছে, নিবরাস ভালো ফুটবল খেলত। তবে গত জানুয়ারিতে সে বাড়ি থেকে চলে যায়।

প্রথম দিকে থাকত ওয়ারীতে। শেষের দিকে উত্তরায় থাকত বলে জানা গেছে। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান নিবরাস গত বছরের জুনেও ভারতীয় নায়িকা শ্রদ্ধা কাপুরের সঙ্গে এক পার্টিতে নেচেছে।

সে ছবি সে তার ফেসবুকেও পোস্ট করে। বন্ধুরা জানিয়েছে, নিবরাসের চালচলনে আধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতির ছাপ ছিল। তাই তার ‘জঙ্গি’ হয়ে ওঠার কাহিনী পরিচিতদের কাছে অচেনা লাগছে।

তবে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে তার বন্ধুরা কেউ মুখ খুলতে রাজি হয়নি। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ অনেকেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র রায়হান মিনহাজ ও আন্দালিব আহমেদের পরিচয় নিশ্চিত করলেও তাদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ :

নিবরাস ইসলামের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি গত শনিবার রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সচল ছিল—এরপর থেকেই অ্যাকাউন্টটি আর ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

একই পরিণতি ঘটেছে অন্য চারজনের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রেও।

গত শনিবার শেষ রাত অবধি তাদের ফেসবুক সচল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যায়।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার বা ঘনিষ্ঠ লোকজন হয়তো তাদের (নিহত সন্ত্রাসীদের) ফেসবুকের আইডি-পাসওয়ার্ড, ফোন নম্বর ও ব্যক্তিগত তথ্য জানত।

দুই মাইক্রোবাসে আসে হামলাকারীরা :

সন্ত্রাসীরা দুটি সাদা মাইক্রোবাসে হলি আর্টিজানে প্রবেশ করেছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছে। তবে তাদের কেউ নাম-পরিচয় প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, দুটি মাইক্রোবাসে এসেছিল তারা। সংখ্যায় আট থেকে দশজন।

জিম্মিদের হত্যার জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে সন্ত্রাসীরা :
জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার পাওয়া একজন গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, শুক্রবার রাত ৯টায় অস্ত্রধারীরা রেস্টুরেন্টটিতে ঢোকে। এ সময় অস্ত্রের মুখে তারা রেস্টুরেন্টের দখল নেয়।

শুরুতেই তারা বলে, ‘আমরা বাঙালিদের হত্যা করব না। তাদের ভয় নেই। আমরা শুধু বিদেশিদের হত্যা করবো।’

তারা বিদেশিদের হত্যা করার পর রেস্টুরেন্টের ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট সংযোগের পাসওয়ার্ড নিয়ে নেয়। এরপর জিম্মি ব্যক্তিদের মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে নিজেদের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তারা।

এভাবে হত্যাযজ্ঞের ছবি আমাক নিউজে পাঠানো হয়। (কালের কণ্ঠ)

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৮:৫০ এএম, ৪ জুলাই ২০১৬, সোমবার
ডিএইচ

Share