মহান ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর পরও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি চাঁদপুরের ভাষা সৈনিকদের। সামগ্রীকভাবে কোনো রাষ্ট্রীয় সংর্ধনা বা সম্মাননা তাদের জোটেনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠিসহ চাঁদপুরেই ২৭ জন ভাষা সৈনিক। আজ পর্যন্ত সরকারিভাবে তাঁদের পরিবারের কোন খোঁজ-খবরও নেয়া হয়নি।
চাঁদপুরের হতভাগ্য এসব ভাষা সৈনিকরা হচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ মরহুম মিজানুর রহমান চৌধুরী, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল ওয়াদুদ পাটওয়ারী, বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহপাঠি প্রবীণ আইনজীবী সাবেক চাঁদপুর মহকুমা যুবলীগ সভাপতি মরহুম এ, এফ, এম ফজলুল হক, বিশিষ্ট সমাজসেবক মরহুম ডাঃ মজিবুর রহমান চৌধুরী, বিশিষ্ট সমাজসেবক মরহুম আবুল কাশেম চৌধুরী টুনু, ঢাকা জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা ও সাবেক এমপি মরহুম আবদুর র, সাবেক এম,পি প্রবীণ আইনজীবি মরহুম আবদুল আউয়াল, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সাবেক গণপরিষদ সদস্য মরহুম আবদুল করিম পাটওয়ারী, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম রফিক উদ্দিন আখন্দ ওরফে সোনা আখন্দ, প্রবীণ রাজনীতিবিদ আইনজীবি শেখ মতিউর রহমান, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ এম,এ গফুর, বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম বি.এম কলিম উল্লাহ, প্রবীণ রাজনীতিবিদ মোল্লা ছিদ্দিকুর রহমান, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আইনজীবি মরহুম আবু জাফর মোঃ মাইনুদ্দিন, সাবেক এম.পি ফ্লাঃ লেঃ (অবঃ) এ, বি, সিদ্দিক, সাবেক এম.পি মরহুম নওজোয়ান ওয়ালি উল্লাহ, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান নুরুল হক বাচ্চু মিয়াজী, প্রবীণ আইনজীবি মরহুম আবুল ফজল, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মরহুম শেখ মুজাফ্ফর আলী, তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ, বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক মরহুম এ,বি খান, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আবদুল করিম খান, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম সুজাত আলী মুন্সী, বিশিষ্ট সমাজসেবক ডাঃ আবদুস ছাত্তার, বিশিষ্ট নারী সংগঠক আমেনা বেগম, তৎকালীন তরুণ সংগঠক মরহুম শাহ্ আমান উল¬াহ্ মানিক ও বিশিষ্ট সমাজসেবক মরহুম এ,কে,এম ফজলুল বারী।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ তথা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়। ইতিহাসের এই অমোঘ কালের সাক্ষীদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহাসিক তাগিদে দেশের অকুতোভয় ভাষা সৈনিকদেরও মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়া একান্ত প্রয়োজন বলে দেশের ইতিহাসবিদরা বিশেষভাবে মনে করেন।
তা নাহলে আগামী প্রজন্ম দেশের সম্যক ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকবে। অথচ আজ সরকারি সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত দেশের কয়েক হাজার অকুতোভয় ভাষা সৈনিক।
তাঁদের মতে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় অকুতোভয় ভাষা সৈনিকদের পরিবার-পরিজনদের সরকারি চাকুরীতে কোটাভূক্ত করার পাশাপাশি সকল ভাষা সৈনিকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় সনদ প্রদান এবং তাঁদের নামে ব্রীজ ও সড়কসহ বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করা যেতে পারে।’
মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে তথা আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবজনক এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৫২সালের এই ঐতিহাসিক দিনে ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়। এ আন্দোলন দানা বেঁধে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে।
সর্বস্তরের মাঝে জ্বলতে থাকে প্রতিবাদের ঝড় ও আগুন। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর বুকের তাঁজা রক্ত দিয়ে বিশ্ব ভাষার ইতিহাসে অকুতোভয় জাতীয় বীরে পরিণত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন জাতিকে এভাবে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়নি।
তাই এই দিনটির যথাযথ গুরুত্ব বিবেচনা করে বিশ্ব সম্মান হিসেবে জাতিসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ঐতিহাসিক মর্যাদা এবং গৌরবময় সম্মানের কারণে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব দরবারে আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। বিশ্বের প্রতিটি দেশ তা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
১৯৫২’র এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকাসহ প্রতিটি জেলা ও মহকুমায় মায়ের ভাষা বাংলা’র জন্য প্রবল আন্দোলন-সংগ্রাম হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের ন্যায় চাঁদপুরেও গড়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট। এই ইউনিটের নেতৃত্বে চাঁদপুরের অনেক কৃতি সন্তান ছিলেন যাঁরা ভাষার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু তাঁরা আজও ভাষা সৈনিক হিসেবে কোন স্বীকৃতি পাননি।
তৎকালীন ভাষা আন্দোলন শুধু সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর বা একুশে পদক পাওয়া ভাষা সৈনিকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তা ছিল সারা দেশের আনাচে কানাচে ভাষার জন্য আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা তথা অসংখ্য গুণীজনের প্রাণান্ত চেষ্টা। যার ফলশ্রুতিতে মায়ের ভাষা বাংলা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত হয়।
চাঁদপুরের অন্যতম এক ভাষা সৈনিক জানান, ১৯৫২সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা শহরে অবস্থিত আহম্মদিয়া মুসলিম হাষ্টেলে (বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ হোষ্টেলে) গোপনে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট’ গঠিত হয়। উপস্থিত সকলের সর্বসম্মতিক্রমে ইউনিটের সভাপতি মনোনীত হন তৎকালীন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ছাত্র নেতা আবদুর রব এবং তৎকালে কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্র নেতা চাঁদপুর সদর উপজেলাধীন রাঢ়ীরচর গ্রামের মোল্লা ছিদ্দিকুর রহমান সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন।
ওই সভার মূল উদ্যোক্তা এবং রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট গঠনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্রনেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এল.এল.বির ছাত্র হাজীগঞ্জ উপজেলার মকিমাবাদ নিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা বি,এম কলিম উল্যাহ।
তাঁকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন ছাত্র নেতা মরহুম আবদুর রব এবং ১৯৪৩সালে কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে পড়াকালীন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহপাঠি বিশিষ্ট আইনজীবি মরহুম এ,এফ,এম, ফজলুল হক। তাছাড়া উপস্থিত আরও অনেকেই বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
উল্লেখিত ২৭ ভাষা সৈনিক ছাড়াও আরো অনেকে রাষ্ট্র ভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট গঠনের ওই সভায় যোগদান করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরে তৎকালীন রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট এর প্রতিনিধি হিসেবে চাঁদপুরের বিভিন্ন থানায় উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আরও অনেকেই।
চাঁদপুরের তৎকালীন ৬টি থানা থেকে তাঁরা এসে এ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে আন্দোলনকে আরও গতিশীল ও বেগবান করে তুঙ্গে নেন। তৎকালীন মুসলীম লীগ নেতাদের চরম বিরোধীতার মুখেও আন্দোলন গর্জে উঠেছিল এবং তৎকালীন পাক-পুলিশ নেতা-কর্মীদের হণ্যে হয়ে খুঁজছিলো গ্রেফতার করে জেলে ঢুকানোর জন্য।
ওই গোপন সভায় বায়ান্নের ভাষা শহীদ সালামের রক্তমাখা শার্ট দেখিয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্র নেতা বি,এম কলিম উল্যাহ। তিনি ২১শে ফেব্রুয়ারি বুলেটবিদ্ধ সালামকে বাঁচানোর জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু বি,এম কলিম উল্যাহ শেষ পর্যন্ত সালামকে বাঁচাতে পারেননি। সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম বীর সালাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সালামের রক্তমাখা শার্ট দেখে চাঁদপুরে ছাত্র-জনতা উত্তেজিতভাবে আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
মূলতঃ এ বিষয়টিই চাঁদপুরে ছাত্র-জনতা আন্দোলনকে আরও বেশি বেগবান ও সম্পৃক্ত করে অর্থাৎ এ বিষয়টি চাঁদপুরে ভাষা আন্দোলনে আগুন ধরিয়ে দেয়। সারাদেশে এ রক্তের আগুনই পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদেরকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ এবং একটি স্বীয় ভূখণ্ডের মানচিত্র ও লাল-সবুজ একটি পতাকা উপহার দানে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছিল।
চাঁদপুরের আরেক ভাষা সৈনিক বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ এম, এ গফুর বলেন, ‘আমি তখন ঢাকা মেডিকেলের এম.বি.বি.এস-এর ছাত্র। ২১শে ফেব্রুয়ারির মিছিলে গাজীউল হক, আবদুল মতিন, অলি আহাদ, আতাউর রহমান খান, আবুল কাশেম (অধ্যক্ষ আবুল কাশেম)-এর ঠিক পিছনে ছিলাম আমি। রাজপথে দেখেছিলাম বুলেটবিদ্ধ রক্তে রঞ্জিত ভাষা শহীদদের শরীর।
তিনি আরো বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের বারান্দায় পড়ে থাকা বুলেটবিদ্ধ সফিউর রহমানকে বাঁচানোর জন্যে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু ততক্ষনে তিনি শাহাদাত বরণ করে না ফেরার দেশে চলে যান।’
: আপডেট ০৪:০০ পিএম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার
ডিএইচ