Home / চাঁদপুর / আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস :‘ আসুন প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি ’

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস :‘ আসুন প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি ’

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘আসুন প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি’। বিশ্ব পরিবেশ দিবস প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপি রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগ ও জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

চাঁদপুরে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তর। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ৫ জুন সকাল সাড়ে ৯ টায় চাঁদপুর সার্কিট হাউজ থেকে র‌্যালি শুরু হয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে শেষ হবে। বেলা সাড়ে ১০ টায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে নদী রক্ষা, বন্যপ্রাণি,ও পরিবেশ,বায়ূ ও শব্দ দূষণ রোধে ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রদর্শন, ১০.৫০ মিনিটে প্রবন্ধ উপস্থাপন ও পুরষ্কার বিতরণ । অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন জেলা প্রশাসক মো.মাজেদুর রহমান ।

বিশেষ অতিথি থাকবেন পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পিপিএম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেয়র নাসির উদ্দিন আহমেদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল । সভাপতিত্ব করবেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শওকত ওসমান ।

৫ জুন জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ কনফারেন্স শুরু হয়েছিল। এ কনফারেন্স ১৯৭২ সালের ৫ জুন নির্ধারিত হয়। কনফারেন্স ঐ বছরই চালু করেছিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। তখন থেকেই প্রতি বছর এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি প্রথম পালিত হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে।

প্রতি বছরই দিবসটি আলাদা আলাদা শহরে,আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পালিত হয়ে আসছে। প্রকৃতিগত কারণে উত্তর গোলার্ধে দিবসটি বসন্তে আর দক্ষিণ গোলার্ধে দিবসটি শরতে পালিত হয়। প্লাস্টিক দ্রব্য বা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার দেশের পরিবেশের ওপর মারাতœক প্রভার ফেলছে। পলিথিন পরিবেশগত ভারসাম্যকে দারুন ভাবে ব্যাহত করে চলছে। তাই প্লাস্টিক ও পলিথিন মুক্ত দেশ গড়তে জাতি,ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই এগিয়ে আসা উচিৎ।

যতদূর জানা গেছে, ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশের বিপুল পরিমাণ প্লাাস্টিক দ্রব্যর ব্যবহার শুরু হয়। ফলে আমেরিকার জনৈক বিজ্ঞানী হালকা,পাতলা ও শক্ত নমনীয় এক ধরণের পলিথিন উদ্ভাবন করেন। সে থেকে ১৯৫৮ সালের সর্বপ্রথম আমেরিকায় উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হয়।

অপর এক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৬ সালে ফিলিপাইনের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড.সোকানো গবেষণা করে ক্যারোলিনা বা এক ধরণের টেট্রন উদ্ভাবন করেন। এর ওপর ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে ৮০’র দশকে প্লাস্টিক ও পলিথিন দ্রব্য বাজারজাত শুরু হয়। সে থেকেই আমাদের দেশে এর প্রচলন দেদারছে অনুপ্রবেশ করে। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিভিন্ন পণ্য কিনে প্লাস্টিক বা পলিথিনে করে তখন তারা নিয়ে আসতে শুরু করে ।

১৯৮৩ সালের ঢাকায় সর্ব প্রথম পলিথিন উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়। ধীরে ধীরে ব্যাপক চাহিদা মেটাতে সারা দেশে প্রায় ১৫ হাজার ছোট বড় পলিথিন কারখানা স্থাপিত হয়। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও পলিথিন দেশের সর্বত্র পরিবেশের ওপর মারাতœক হুমকি সৃষ্টি করে যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্মুখীন হচ্ছে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ।

প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের ব্যাপকতা যে কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে-তা বলে শেষ করা যাবে না।এক কথায় দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ব্যবহার মাত্রারিক্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের ছোট,বড়,শহর,বন্দর নগর হাট বাজার রেলস্টেশন,লঞ্চ স্টেশনের যে কোনো দোকানেই পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিক দ্রব্য পাওয়া যায়। এখন গ্রামে,শহরে ,বন্দরে গৃহিণারা ব্যাপক হারে প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। এ প্লাস্টিক বা পলিথিন পচনশীল নয় বিধায় পরিবেশের ওপর মারাতœক হুমকি। এটা সম্পূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা তৈরি।

বিজ্ঞানীদের মতে,পলিথিন বা প্লাস্টিক ক্ষয় হয় না এবং অনেক বছর অক্ষত থাকে। ইহা মাটির জন্য খুবই ক্ষতিকর। ব্যবহারের পর মাটিতে ফেলে দেয়া হলে মাটির মারাতœক ক্ষতি করে,মাটিতে সূর্য রশ্মি পৌঁছাতে বিঘœ ঘটায়,ফসলের জমিতে উৎপাদন ব্যহত করে,আগুনে পুড়লে জনস্বাস্থ্যের মারাতœক ক্ষতি করে,শহর নগর ,বন্দরের সকল প্রকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার মারাতœক বিঘœ সৃষ্টি করে,নালা নর্দমা বন্ধ করে মারাতœক দুর্গন্ধ বাড়ায় বিধায় জনস্বাস্থ্যের মারাতœক ক্ষতিকর,শহর বা গ্রামের গৃহিণী তাদের আর্বজনা ও শিশুদের মলমূত্র পলিথিন বা ভাঙ্গাচুড়া প্লাস্টিক পাত্র ভরে যেখানে সেখানে ফেলে দেয়। পশু পাখিরা তা’পা দিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পরিবেশ দূষণ বাড়ায়।

অপর দিকে এর ব্যাপক ব্যবহারের ফলে দেশের সোনালী আঁশ পাটের সকল প্রকার দ্রব্য সামগ্রীর শিল্প কারখানা ধ্বংস হয়ে বেকার সমস্যা বাড়াচ্ছে ও এসব শিল্প দ্রব্যের বিলুপ্ত ঘটিয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশেই পলিথিন বা প্লাস্টিক দ্রব্য ও ব্যাগের উৎপাদন,ব্যবহার ও বাজারজাত সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়াও দ্রæত পচনশীল ও ধ্বংস হয় এমন ব্যাগ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিকল্প দ্রব্য হিসেবে উৎপাদন করছে। যাহার কোনোই নেতিবাচক প্রভাব নেই।

প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যাগ যেমন পরিবেশ ক্ষতি করছে তেমনি দেশের চলমান অর্থনৈতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উহা সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বাজার পড়ে গেছে। বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ।

ঐসব উৎপাদনে নিয়োজিত মাত্র কয়েক হাজার লোক দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাতœক ক্ষতি করে চলছে। যার ফলে ১৯৯৪ সালে পলি বা প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন,আমদানি ,ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা সত্তে¡ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকের হুমকির ভয়ে তা আর কার্যকরি করা সম্ভব হয় নি।পরবর্তীতে সরকার দেশের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে এর সকল প্রকার ব্যবহার,উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১ জানুয়ারি ২০০২। ১ মার্চ ২০০২ থেকে সারা দেশে এর কার্যক্রম অব্যহত থাকে। যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ছিলো।

বর্তমান সরকার এরইমধ্যে দেশের উৎপন্ন ১৭ দ্রব্য প্যাকেট বা বাজারেজাত করতে প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। পাটের ব্যাগের বিপক্ষে পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে এ অভিযান পরিচালনা করার লক্ষ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ।পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ এ নির্ধারিত ১৭ টি পণ্য যেমন ধান, চাল, গম, ভূট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, পেয়াঁজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা ও তুষ-খুদ-কুড়া পরিবহণ ও সংরক্ষণে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সরকার পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি ও পরিবেশ সুরক্ষায় সারাদেশে বিশেষ অভিযান শুরু করে। জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ এ অভিযান সফল করতে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথেও আন্ত : মন্ত্রণালয় সভা এবং পাটজাত পণ্য প্রদর্শনী অব্যাহত রাখার নির্দেশ রয়েছে ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সোনালী আঁশ পাটের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়ায় দেশে-বিদেশে পাটের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। সোনালী আঁশ পাটের উৎপাদন এবং এর বহুমুখী ব্যবহারকে উৎসাহিত ও জনপ্রিয় করতে ১৭টি পণ্যের পাটজাত মোড়কের ব্যবহার নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিরোধী প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার ও উৎপাদন বন্ধে সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

তাই সরকার এ আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সারাদেশের সকল প্রকার সড়কপথ, জলপথ, স্থলবন্দর, মালামাল পরিবহণকারী যানবাহন, উৎপাদনকারী, প্যাকেটজাতকারী, আমদানিকারক-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ অভিযান স্বরাষ্ট্র,বন ও পরিবেশ, সড়ক ও সেতু পরিবহণ, নৌ-পরিবহণ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ,জেলা প্রশাসন,পুলিশ প্রশাসন ও র‌্যাবের সহায়তায় এ অভিযান পরিচালিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে পরিবেশের ওপর রিরূপ প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশের দূষণ বাড়ছে ।

এছাড়াও বায়ু দূষণ,শব্দদূষণ,পানি দূষণ প্রভৃতি দূষণে জনজীবন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। সরকার প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করে এর বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে প্লাস্টিক বা পলিথিনের বিকল্প দ্রব্যগুলোর দাম ও সহজলভ্য করার প্রক্রিয়া সৃষ্টি করায় ব্যাপক গণসচেতনতা বৃদ্ধি পায়।

এদিকে ওয়েল্ড্রিং কারখানা,সাবান,রং, ট্রেনারি শিল্প কারখানা ও হাসপাতালের বর্জ্যে পরিবেশকে দূষণ করছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে নদী,খাল,বিল পুকুর ও ডোবার পানি দূষণও বাড়ছে । এসব কারণে আমাদের জীব-বৈচিত্র্য ও মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। দেশের নদ-নদীর পানি দূষিত হয়ে মৎস্য সম্পদ, কৃষি উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত ও জলবায়ূ পরিবর্তন হয়ে মানুষের নানা রোগ বালাই দৃশ্যমান হচ্ছে।

আমাদের দেশ প্রকৃতির লীলাভূমি । যেকটি বন রয়েছে তম্মধ্যে সুন্দরবন একটি । সুন্দরবনসহ অন্যান্য বনে ৪০ প্রকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী আজ বিপন্ন,অতিবিপন্ন বা সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। বন বিনাশ, পিটিয়ে মারা,শিকার করে , রোগাকান্ত দ্বারা আক্রান্ত ,পর্যাপ্ত খাবার ও প্রাকৃতিক বন্যা,মহামারি, দুর্যোগ,ঘূর্ণিঝড় ও আশ্রয়ের অভাব ও আগুন লাগিয়ে বন উজাড় হওয়াতে এ সব প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন কমছে।

পৃথিবীর বৃহত্তম ৩টি ম্যানগ্রোব এর মধ্যে বাংলাদেশের সুন্দরবন একটি । এর আয়তন ১০ হাজার কি.মি.। আর বাংলাদেশের অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কি.মি.। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসীম।এ বনে ২ শ’৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাস্থল আছে ।

এর আশ-পাশের লোনা পানিতে রযেছে হাঙ্গর,কুমির,ডলপিন ও ২শ’৫০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ সব প্রাণীকূল ও জীব বৈচিত্র পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা পালন করে। জলবায়ূর পরিবর্তন পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। তাই জীব-বৈচিত্র্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

দেশ ও জাতীয় স্বার্থে দেশের প্রতিটি নাগরিককে প্লাস্টিক দ্রব্য বা পলিথিন বর্জনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তা কার্যকর করতে সহায়তা করতে হবে।

প্রতিবেদক-আবদুল গনি
আপডেট,বাংলাদেশ সময় ৬: ০০ পিএম, ৪ জুন ২০১৮,সোমবার

Leave a Reply