Home / জাতীয় / রাজনীতি / ৪৪-এ বিএনপি
বিএনপি

৪৪-এ বিএনপি

সৃষ্টিকর্তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারার্থে সমাজতন্ত্র এই চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। ৪৩ বছর পর বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বিএনপি আজও দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল। ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে দলটি নানা সংকটে ধুঁকছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে গড়া জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মূল চেতনা থেকে সরে আসাটাই বিএনপির সংকটের প্রধান কারণ। তারা বলছেন, জিয়াউর রহমান দলে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তা এখনকার বিএনপি ভুলতে বসেছে। একের পর এক নীতিগত ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দলটি রাজনীতির মাঠে উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। তারা বলেন, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে বিএনপি তার মতো একজন নেতাকেও তৈরি করতে পারেনি যিনি খালেদা জিয়ার অবর্তমানে গোড়ালি শক্ত করে রাজনীতির মাঠে দলকে সক্রিয়ভাবে টিকিয়ে রাখতে পারবেন। যদিও দলটির বর্তমান নেতৃত্বতে যারা আছেন তারা এ কথা মানতে নারাজ।

টানা ১৩ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। সর্বশেষ নির্বাচনে চরমভাবে বিপর্যস্ত দলটি। বিপুল জনসমর্থন থাকার পরও সঠিক সিদ্ধান্ত ও কৌশলের অভাবে কোনোভাবেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না বিএনপি। নেতাকর্মীরা হতাশায় ভুগছেন। নেতৃত্বের সংকট, সময়কে অনুধাবনের অক্ষমতা, একগুঁয়েমি, বিভিন্ন পর্যায়ে যোগ্য ও দক্ষ নেতা নির্বাচনে ব্যর্থতার কারণেই দীর্ঘ সময় ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে। বিএনপি সরকার, সংসদ, রাজপথ কোথাও নেই। প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অবস্থান এখন কোথায়? সে বিষয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

দ্রুত বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতাকর্মীদের সঠিক ক্ষমতায়ন করে দলটির ভেতরে অধিকতর গণতান্ত্রিক ভাব আনতে হবে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিশোধন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ নীতি বলতে দলীয় কর্মসূচি প্রণয়ন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা কী হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। এর পাশাপাশি বিএনপির নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো দাঁড় করাতে হবে।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তার শাসনামলের শেষদিকে সার্ক প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করলেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আমল থেকে বিএনপি ভারত বিদ্বেষী রাজনীতিতে সরব হয়। ভারত বিদ্বেষের নামে সৃষ্টি হয় হিন্দু বিদ্বেষও। কিন্তু ভোটের হিসাব কষে পলিসিগত কারণে ভারত বিরোধী অবস্থান থেকে বর্তমানে সরে এসেছে দলটি। এ বিষয়ে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে।

সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের মতো ভারতও এ দেশে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য কী প্রয়োজন, সে সম্পর্কে বিএনপির চাওয়াগুলো তাদের জানানো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বেশ কিছু সমস্যা আছে। জিয়াউর রহমান যে রাজনীতি করেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সমস্যাগুলো সেগুলো তিনি দ্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন। এ বিষয়ে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। তার যে বক্তব্য সেখানে তিনি বলতেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছিলাম সেভাবে আমাদের দাবি আদায়েও লড়াই করে যেতে হবে। বাংলার পানি বণ্টনের জন্য তিনি মওলানা ভাসানীকে অনুরোধ করেছিলেন লং মার্চ করার জন্য। কিন্তু বর্তমান বিএনপিকে এসব বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখা যায় না। তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে হলে মানুষের যেসব দাবি, আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে তা ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি সেটাকেও বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। ভারত বিরোধী অবস্থান তাদের জোরালোভাবে স্পষ্ট করতে হবে।

তিনি বলেন, বিএনপিকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের কথা চিন্তা করে রাজনীতি করতে হবে। কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে জনগণের শক্তির ওপর ভরসা করে জিয়াউর রহমান যেভাবে জনগণের শক্তির ওপর ভরসা করে রাজনীতি করতেন তাদেরও কারও অনুকম্পার আশা, কোনো শক্তির আশা বাদ দিয়ে এগুতে হবে।

ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শের বিষয়টি তুলে ধরতে পারলেই বিএনপির সব সমস্যার সমাধান আসবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক না রেখে নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। কারণ, পরিস্থিতিই সঠিক নেতৃত্ব তৈরি করে।

দলের সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি কঠিন দুঃসময় অতিক্রম করছে। তবুও জিয়াউর রহমানের নীতি এবং আদর্শ থেকে এক পা-ও নড়েনি। তার তৈরি করা গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে বিএনপি লড়াই করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সমালোচনার কোনো সুযোগ নেই। এখনকার বিএনপি অন্য সময়ের তুলনায় বেশি শক্তিশালী। বিএনপি সংগ্রাম করছে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।

তিনি বলেন, আমাদের শপথ হচ্ছে, গণতন্ত্রের নেত্রী খালেদা জিয়াকে স্থায়ীভাবে কারামুক্ত করা। বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে এবং দলে কোনো নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই।

ইসলাম ধর্ম তথা ধর্ম বিশ্বাসী দল হিসেবে বরাবরই সাধারণ জনগণের সহমর্মিতা অর্জন করে যাচ্ছে বিএনপি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অনেক কিছুই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ফিরিয়ে আনা হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা জামায়াত নেতারা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে একে একে ফিরেও আসেন। জামায়াতে ইসলামীর ‘পুনর্জন্ম’ না হলে বাংলাদেশে ধর্মের রাজনীতি এভাবে বিকশিত হতো না। পরবর্তীতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াতকে ফিরিয়েছিল বিএনপি। এমনকি তাদের রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেয় দলটি। এরপর দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ব্যাপক বিকাশ ঘটে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াতের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দায়ে বিভিন্ন দেশি এবং আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মুখে ধর্মভিত্তিক দলের তোকমা থেকে বের হতে চাইছে বিএনপি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন, কোনো দেশ বা দলের বিরোধিতা থেকে নয়, নানা সংকট মোকাবিলা করে বিএনপি ৪৩ বছরে একটি পরীক্ষিত জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় কোনো ধর্মভিত্তিক দলের ওপর ভরসা রেখে বিএনপি চলছে না। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ভোটের রাজনীতি। তবে ভবিষ্যতে তাদের ছাড়া নাকি তাদের সঙ্গে নিয়েই বিএনপি পথ চলবে সেটা সময়ই বলে দেবে।

১৯৭৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক পথ-মতের অনুসারীদের এক প্ল্যাটফর্মে এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে চলছিল উত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানের পালা। সেই পটভূমিতে ওই বছরের ৭ নভেম্বর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। এরপর প্রথমে তিনি ১৯ দফা অর্থনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে ‘জাগদল’ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেন। সেই প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যায়ে বিএনপির জন্ম হয়।