জাতীয়

৪০ হাজার রোহিঙ্গার প্রবেশ : সীমান্ত সীল করার সিদ্ধান্ত

মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সহিংসতায় প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে – এমন তথ্য পাওয়ার পর সরকারের ভেতরে-বাইরে তোলপাড় চলছে। নীতি-নির্ধারকরা নড়েচড়ে বসেছেন।

তারা ক্ষুব্ধ। তবে এ নিয়ে এখনই প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাইছেন না। স্থানীয় প্রশাসনকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির বর্ণনাসহ ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।

অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ নজরদারি নিশ্চিত করতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী, কোস্টগার্ড এবং মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে সীমান্ত সিল করে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তও হয়েছে।

অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিক বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সদ্য সমাপ্ত বৈঠক থেকে ওই নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত আসে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বুধবার বিকালে টাস্কফোর্সের বৈঠকটি হয়।

পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বৈঠকে উপস্থিত সরকারি এক কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনকে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুরোধ এবং মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ রাখাইনের সহিংসতা থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

কিন্তু এ সুযোগে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া (পুশ করা) হয়েছে। এটি পরিকল্পিত ঘটনা। জনবহুল বাংলাদেশের জন্য এটি বাড়তি চাপ। সরকারের দায়িত্বশীল অন্য এক কর্মকর্তা অবশ্য পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করছেন ভিন্নভাবে। তার মতে, পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে অনেকের হাত নেই, পা নেই, এ অবস্থায় তারা সীমান্তে এসেছে।

বাংলাদেশে আশ্রয়ের আশায় ঘুরছে। মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অগ্রাহ্য করার উপায় ছিল না বাংলাদেশের। কিন্তু সেই সংখ্যা ৪০ হাজার!

অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসনের এখানে কোনো ব্যর্থতা দেখেন কিনা- এমন প্রশ্নে সরকারের দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর নেয়ার পরামর্শ দেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করছে? জানাতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা সীমান্তে নজরদারি আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া এখানে আগে থেকে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছেন এবং নতুন করে যারা আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সবাইকে ফেরত নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করছি।

মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ওআইসি চাপ দিচ্ছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া চাপ দিচ্ছে। এ নিয়ে আসিয়ানের বৈঠক হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী সেখানে কথা বলেছেন। তিনি পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখতে বাংলাদেশ সফর করেছেন। উখিয়ায় নতুন-পুরাতন নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে।

তাদের মুখে তিনি নির্যাতনের বর্ণনা শুনেছেন। বৈঠকে উপস্থিত এক কূটনীতিক বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এখনই ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠকে। গত ৯ই অক্টোবর থেকে রাখাইনে সহিংস পরিস্থিতি জিইয়ে রাখা হয়েছে। যার ফল বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তে মানবিক সংকট চলছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ রাখাইন-সহিংসতার সবচেয়ে বড় ভিকটিম।

৩২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী (নিবন্ধিত) এবং প্রায় ৫ লাখ অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে এখানে অস্থায়ী আশ্রয়ে রয়েছে। নতুন করে আরো প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে; যা নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সীমান্তে নজরদারি আরও বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রয়োজনে সীমান্ত বন্ধ বা সিল করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

টাস্কফোর্সের দীর্ঘ বৈঠকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সোনাবাহিনীর অভিযান এবং রোহিঙ্গাদের নির্মূলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কতিপয় উগ্রপন্থি গ্রুপের তাণ্ডবের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে কথা হয়।

বৈঠকে সরকারি মদতে রাখাইনে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সীমান্তে ঠেলে দেয়ার দীর্ঘ দিনের অপচেষ্টার নিন্দা জানানো হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ৩৪ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

সেটি গত সপ্তাহের হিসাব। চলতি সপ্তাহে নতুন করে আরো ৬ হাজার মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে ঢুকেছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যাদের সবাই রোহিঙ্গা। অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিকদের চলমান আদমশুমারির আওতায় আনার সিদ্ধান্তের কথাও জানান ওই কূটনীতিক।

টাস্কফোর্সের বৈঠকের আগের দিন (মঙ্গলবার) কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এলপি মারসুদি। পরিদর্শনে তার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ মাহমুদ আলী, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও সচিব মো. শহিদুল হক।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনোকে উদ্ধৃত করে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, রোহিঙ্গা সমস্যার উৎপত্তি মিয়ানমারে এবং এর সমাধান সেখানেই হতে হবে। মন্ত্রী রেতনো বলেন, শরণার্থীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তাদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরো কিছু করা উচিত।

টাস্কফোর্সের বৈঠকে ইন্দোনেশিয়ার মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি আলোচনা হয়। এ নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বৈঠককে অবহিত করেন।

ইন্দোনেশিয়ার অনুরোধে ঢাকায় বিশেষ দূত পাঠাচ্ছেন সু চি: রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনায় ইন্দোনেশিয়ার অনুরোধে বাংলাদেশে বিশেষ দূত পাঠাচ্ছেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সূচি।

ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এলপি মারসুদি তার ঢাকা সফরে এমনটাই জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে। মাহমুদ আলী তাৎক্ষণিকভাবে সূচির প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে গতকাল সন্ধ্যা (এ রিপোর্ট লেখা) পর্যন্ত মিয়ানমারের তরফে দূত পাঠানোর আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব ঢাকা পায়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্তত দুটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্র মতে, রোহিঙ্গা সমস্যা সত্ত্বেও মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকার প্রশংসা করেছেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আগামীদিনে দুই দেশের আরও বিস্তৃত এবং গভীর সম্পর্ক গড়ার মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক সব সমস্যার সমাধানে উভয়ের ভূমিকা আশা করে জাকার্তা।

নিউজ ডেস্ক ।। আপডটে, বাংলাদশে সময় ০১ : ০০ এএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ শুক্রবার
ডিএইচ

Share