বিয়ে হয়েছিল জামিলা খাতুন আর মুরশিদা খাতুনের। স্বামীর সংসার করার স্বপ্ন ছিল তাদের মনে। ভেবেছিলেন সুখে থাকবেন স্বামী-সন্তান নিয়ে। কিন্তু গরিবের সুখ অল্পদিনের। তা নিভে যায় দ্রুত। জমিলা বিয়ের দুই বছরের মাথায় আর মুরশিদা বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় নিশ্চিত হন, সুখ এ পর্যন্তই। তারপর দুজনকেই ফিরে আসতে হলো বাবা-ভাইয়ের অভাবী ঠিকানায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ৪০ বছর অভাবকে সঙ্গী করে পার করছেন জীবন।
এদিকে সরকারি ভাতা পেলেও একটি ঘরের জন্য চেয়ারম্যান আর মেম্বারের দ্বারে দ্বারে বহু বছর ঘুরেও ঘর পাননি জামিলা খাতুন ও মুরশিদা খাতুন। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অন্যের সংসারে কাজ করে কষ্টে দিন পার করছেন এই দুই ভূমিহীন। জীবনের শেষ কটা দিন নিজেদের ছোট্ট একটি ঘরে কাটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন অসহায় এই দুই নারী।
জানা যায়, ১৯৭৯ সালের দিকে বিয়ে হয়েছিল জমিলা খাতুনের। তার স্বামীর নাম মুকছেদ। বিয়ের পর জানতে পারেন স্বামী আগে এক বিয়ে করেছেন। তারপরও সুখের আসায় স্বামীর ঘরে গেলেও কপালে সুখ সইল না। ফিরে আসতে হলো বাবার বাড়িতে। এখানে আসার পর এক মেয়েসন্তান বিলকিছ আকতারের জন্ম হয়। কয়েক বছর পর স্বামীও মারা যান। নিরুপায় হয়ে থাকতে হলো ভাইয়ের সংসারে।
এদিকে ভাইয়ের অভাবের সংসারে যখন চুলা জ্বলে না, তখন জমিলা নেমে পড়েন কাজে। মানুষের কৃষিকাজ থেকে শুরু করে ঘরের কাজ, কোনো কাজই বাদ দেননি। সারাদিন কাজ শেষে গৃহস্থরা ধান, টাকা ও খাবার দিতেন, তা এনে ভাগ করে খেতেন ছোট ভাইয়ের সন্তানদের নিয়ে। এভাবেই কেটে গেল জমিলার ৪০ বছর।
সরেজমিনে দেখা যায়, কাজ করে ফিরেছেন জমিলা খাতুন। গায়ে মলিন কাপড়। অসুস্থ। মাথা গোঁজার ঠাঁই একটি ঘরও জরাজীর্ণ। ঘরের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরে নেই বিদ্যুতের সংযোগ, পাননি কোনো সরকারি সৌরবিদ্যুৎ। ভেতরে একটি খাট, তাও নড়বড়ে।
জানতে চাইলে জমিলা খাতুন বলেন, আমার স্বামী মরি (মারা) গেছে। একটা মাইয়ারে নিয়া ভাইয়ের অভাবের সংসারে আছিলাম। ৪০ বছর ধরে মানুষের কাজ করি বাঁচি আছি। কোনো দিন ভিক্ষা করিন। কষ্ট করি চইলছি। আমি অসুস্থ। চিকিৎসাও করাইতে পারি না। এখন আর কাজও করতে পারি না। মানুষের কাজ করে টাকা জমিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এখন মেয়েকেও সাহায্য করতে হয়।
জনপ্রতিনিধিদের কাছে কখনো গিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নে বলেন, তাগো কাছে অনেকবার গেছি। গেলেই বলে, ‘নাই। সরকার দেয় না। দিলেও কয়জনরে দেয়?’ আগে তো বোর্ড অফিস থেকে চাইল দিত, ভাতা দিত। এখন তাও দেয় না। শুনছি এমপি ঈদেও টিয়া (টাকা) দিছে, সরকার দিছে, আমরা কিছু পাইনাই। দুই শতাংশ জায়গা আছে। মেম্বার, চেয়ারম্যান, নেতাদের কইছিলাম একটা ঘর করি দেন। তাও দিল না। যারা টিয়া দেয়, তাগোরে করি দেয়।
জমিলার ভাই আবুল কাশেম বলেন, আমার বোন এত বছর ধরে আমাদের বাড়িতে আছে। আমারও অভাব। বোনকে তেমন কিছু করতে পারি না। মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে কতবার গেছি, কেউ সাড়া দেয় না। প্রধানমন্ত্রী সরকারি ঘর দেন। আমার বোনের জায়গার ওপর যদি একটা ঘর করে দেয় সরকার, তাহলে উপকার হয়।
১৯৮১ সালে বিয়ে হয় মুরশিদা খাতুনের। তার বাবা মৃত আবদুল মোনাফ। তার স্বামী মোবারক হোসেন অতিদরিদ্র হওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে থাকতেন। তাদের ঘরে জন্ম নেয় দুই কন্যাসন্তান কুলসুম আকতার ও সুমি আকতার। কিন্তু কয়েক বছর পর তাকে রেখে তার স্বামী চলে যান। মুরশিদাও শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আর জায়গা পাননি। তারপর অভাবী বাবার সংসারেই থেকে যান।
সরেজমিনে দেখা যায়, একটি ঝুপড়ি ঘরে অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছেন মুরশিদা খাতুন। পাশে তার মেয়ে কুলসুম আকতার মায়ের সেবা করছেন। তার ঘরেও অন্ধকার। টিনের ফাঁকে আকাশ দেখা যায়। ঘরের পাশে ছোট একটা রান্নাঘর। নিজের ব্যবহারের নেই শৌচাগারও।
মুরশিদা খাতুন বলেন, স্বামী তো আমারে রাইখা চলি গেছে। আমি ৪০ বছর ধরে মাইনষের কাজ করি দুই মেয়েকে বড় করেছি। তাদের বিয়ে দিয়েছি। বড় মেয়ে খুব গরিব। তাই আমার কাছে থাকে। ছোট মেয়েরও অভাব। তাকেও সাহায্য পাঠান লাগে।
সরকারি কোনো সুবিধা পান কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, একবার চেয়ারম্যান অফিস থেকে ছয় হাজার টাকা পাইছি। আরেকবার তিন হাজার টাকা পাইছি। আর কোনো চাল পাই নাই। এখন কিছু পাই না। শুইনছি ঈদে সরকার কত কিছু দিছে, আমরা কিছুই পাইনাই।
তিনি বলেন, আমি অসুস্থ। আমার ব্রেনে সমস্যা। চিকিৎসা করাইতে গেছিলাম আত্মীয়র বাড়িত। আসার পর গ্রামের নেতাদের কাছে কতবার গেছি একটা ঘরের জন্য। তারা বলে তুমি ছিলা না, তাই নাম দেওয়া হয় নাই। গেলে তারা বিরক্ত হয়। এখন আর যাই না। আমার দুই শতাংশ জায়গার ওপর ঘর। বর্ষাকালে পানি ঢোকে। সরকার যদি আমারে একটা ঘর দেয়, তাইলে বর্ষাকালে একটু শান্তিতে থাকতে পারমু।
মুরশিদার মেয়ে কুলসুম আকতার বলেন, আমার মায়ের স্বামীর সংসার করার ভাগ্য হয়নি। আমার নানার সংসারেই আমাদের নিয়ে ছিলেন। সারা জীবন চোখে অভাব দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। আমার মা মানুষের কাজ করে খান। সমাজের কত বড়লোক, জনপ্রতিনিধিরা যদি আমার মাকে একটু সাহায্য করেন, তাহলে চিকিৎসা করাতে পারব।
পানচাইল গ্রামের বাসিন্দা আবু সাঈদ লিটন বলেন, আমার জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি জমিলা খাতুন ও মুরশিদা খাতুন অন্যের বাড়িতে কাজ করে দিনাতিপাত করছেন। অভাব যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। পানচাইল গ্রামে তারা দুজনই অতিদরিদ্র। এত বছর পরও গ্রামের সচ্ছল ব্যক্তিরা ও জনপ্রতিনিধিরা যদি তাদের দিকে খেয়াল রাখতেন, তাহলে তাদের অভাব দূর হতো। প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে ঘর দিচ্ছেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারা ঘর পাওয়ার যোগ্য বলে আমি মনে করি।
পানচাইল গ্রামের পল্লিচিকিৎসক কামাল হোসেন খোকা বলেন, জমিলা খাতুন ও মুরশিদা খাতুন এ গ্রামের অতিদরিদ্র মানুষ। তারা অন্যের কাজ করে খান। জমিলা খাতুনের ঘর পাওয়ার জন্য কাগজ জমা দেওয়া হয়েছে। মুরশিদা খাতুনের বিষয়ে জানি না। তবে তারা দুজনে ঘর পেলে খুব উপকার হবে তাদের।
এ বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আমিনুল হক বলেন, পানচাইল গ্রামের পাল বাড়ির জামিলা খাতুন ও মুরশিদা খাতুনের নামে ঘর বরাদ্দের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাদের মতো এমন অনেকেই আছেন ঘর পাননি। আমি নাম পাঠিয়েছি, বাকিটা চেয়ারম্যান জানেন। ঘর বরাদ্দের জন্য জামিলা খাতুন ও মুরশিদা খাতুমের নাম আলাদা করে বলার সুযোগ হয়নি। সম্ভব হলে তাদের বিষয়ে কথা বলব।
ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবু ইউসুফ পাটওয়ারী বলেন, জামিলা খাতুন ও মুরশিদা খাতুনের নাম ঘর বরাদ্দের তালিকায় আছে কি না, আমার জানা নেই। আমরা ইউনিয়নে যারা আবেদন করেছে, সবাই ঘর পেয়েছে। ইউপি সদস্য তাদের বিষয়ে আমাকে কিছু বলেননি। তারা যদি আবেদন করেন, আমি ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখব।
শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিরীন আক্তার বলেন, শাহরাস্তি উপজেলায় ঘর পাওয়ার জন্য শত শত মানুষের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। সবাইকে তো আর ঘর বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। জামিলা খাতুন ও মুরশিদা খাতুনের নাম ইউপি সদস্য কিংবা চেয়ারম্যান আমাকে আগে বলেননি। জমিলা-মুরশিদা যদি সরাসরি আমার কাছে এসে আবেদন করেন, আমি তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করব।
প্রতিবেদক:শরীফুল ইসলাম,২৫ মে ২০২১