৩৫ তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন নাজমা ইয়াসমিন মুন্নি। নাজমা ইয়াসমিন ৮/১০ জন সাধারণ মানুষের মতো নয়। তিনি আড়াই বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে দু’চোখের আলো হারিয়েছেন।
তবে থেমে থাকেননি কখনো। চোখে আলো না থেকেও যে স্বপ্ন জয় করা যায় তার অনন্য প্রমাণ নাজমা। বর্তমানে ইডেন মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক তিনি।
নাজমা ইয়াসমিন বলেন, এ পথ পাড়ি দেয়া মোটেও সহজ ছিল না আমার জন্য। জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করেছি। তবে কখনো থেমে থাকিনি।
ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করে অনেক বড় হবো। বিয়ে করার স্বপ্ন কখনো ছিলই না। তবুও বিয়েটা আমার জীবনে দুঃস্বপ্ন হিসেবে আসে। এখন আমি আমার দুই সন্তান নিয়ে খুব ভালো আছি।
পরিবারে পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড় নাজমা ইয়াসমিন। বাবা-মা কখনো অন্য সন্তানদের থেকে আলাদা ভাবেন নি তাকে। বরং একটু বেশিই পেয়েছেন তিনি।
টাইফয়েডে চোখের আলো হারানোর পর পাঁচ বছর বয়সে ব্যাপ্টিস্ট সংঘ অন্ধ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয় তাকে। সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
পরবর্তীতে বালিকা বিদ্যালয়ের সহায়তায় মিরপুর গার্লস আইডিয়েল ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
প্রিটেস্ট পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখা করেছেন। এরপর থেকে শ্রুতিলেখকের সাহায্য নিয়ে লেখাপড়া করেছেন নাজমা।
তিনি বলেন, আমার প্রথম শ্রুতিলেখক ছিল অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্র। আমার থেকে ছোট ক্লাসের হওয়ায় বিভিন্ন বিষয় সে বুঝতো না। আমাদের জন্য কোনো বাড়তি সময়ও নেই পরীক্ষায়। এইসব নিয়ে সমস্যায় পড়তে হতো।
নাজমা বলেন, একবার ইংরেজি পরীক্ষার সময় আমার পাশে বসা অন্যদের সমস্যা হওয়ায় পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে আমাকে তিন তলা থেকে নিচ তলায় নিয়ে আসে।
সেখানে প্রায় ত্রিশ মিনিট সময় নষ্ট হয়। কিন্তু সেদিনও আমাকে অতিরিক্ত সময় দেয়া হয়নি। তবুও পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করি। এজন্য আমার শিক্ষকরা আমাকে অনেক ভালোবাসতেন।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হই। আমি সবসময়ই নিজেকে প্লেস করার চেষ্টা করতাম। দশজনের মধ্যে একজন হতে চাইতাম। ভালো রেজাল্ট করায় আমাকে অন্য কলেজে ভর্তি হতে দেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ। এমনকি উৎসাহ দেয়ার জন্য আমাকে বৃত্তি দেয়া হতো।
তবে অন্য অনেক মেয়ের মতো ২০০১ সালে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হয়। তবে বিয়েটা আমার জন্য সুখকর ছিল না। পাঁচ বছরের মধ্যেই ডিভোর্স হয়ে যায়।
ততদিনে আমি দুই সন্তানের মা। সুখের বিষয় হচ্ছে বিয়ের পরও লেখাপড়া থামাই নি। প্রথম বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় খারাপ করলেও দ্বিতীয়বার সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হই।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তির সংযোগ পাই। ভর্তির পর পর চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেই।
কারণ স্বাবলম্বী হওয়া আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাবা-মায়ের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভর হতে চাননি। প্রথম সন্তানের এক বছর বয়স থেকেই তিনি চাকরি করেন। অডিট ডিপার্টমেন্টে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন।
নাজমা ইয়াসমিন বলেন, আমি এই চাকরি আমার জন্য রহমত হিসেবে গ্রহণ করেছি। অফিস ঢাকায় থাকায় প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সহায়তায় ক্লাস এবং পরীক্ষার সব খবর রাখতেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম সবসময় একাই আসা-যাওয়া করতেন তিনি।
নাজমা ইয়াসমিন বলেন, সারাদিন আমার দুই ছেলেকে বাবা-মা দেখাশুনা করতেন। চাকরি করে রাতে বাসায় ফিরে দুই সন্তানকে দুই পাশে রেখে টেপ রেকর্ডার থেকে পড়া আত্মস্থ করতাম।
টাকা দিয়ে বিভিন্ন মানুষের মাধ্যমে ক্লাসের পড়া, সম্ভাব্য সিলেবাস সবকিছু রেকর্ড করে নিতাম। এভাবেই অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করি।
নাজমা ইয়াসমিন বলেন, ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রিলিতে শ্রুতিলেখক পাচ্ছিলাম না। এক মেয়ে আমার লেখক হওয়ার কথা ছিল।
পরীক্ষার মাত্র এক সপ্তাহ আগে সে পরীক্ষায় বসতে পারবে না বলে জানায়। এদিকে নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যয়নপত্র জমা দেয়ার তারিখ পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে। এরপর কৃষ্ণ নামে আইন বিভাগের একজন ছাত্র আমাকে সাহায্য করেন।
তিনি বলেন, এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রিলি এবং লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এরপর ভাইবার সময় আমাকে শিক্ষকরা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন।
সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিল আমাকে যতগুলো প্রশ্ন করা হয়েছে আমি সব উত্তর দিতে পেরেছি। এইসব বিষয় আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু আমি কখনো পিছু হটিনি।
তিনি আরো বলেন, আমি আমার চাকরি এবং পড়ালেখার জন্য সন্তানদের কোনো ক্ষতি হতে দেইনি। সময়মতো স্কুলে ভর্তি করা থেকে শুরু করে সবকিছু করেছি।
এমনকি প্রথম সন্তান সিয়ামুর রহমানকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নিজেই পড়িয়েছি। দ্বিতীয় সন্তান সায়মুর রহমানকে এখনো আমি নিজেই পড়াই।
এই অর্জনে পিএসসির অবদানের কথা উল্লেখ করে নাজমা ইয়াসমিন বলেন, কাজের ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে সবধরনের সহায়তা পেয়েছি।
তবে যেসব কলেজে আমরা পরীক্ষা দেই শিক্ষকরা আমাদের বুঝতেন না। আমরা যারা প্রতিবন্ধী তাদের অনেক সময় ক্যান্ডিডেট হিসেবে দেখে না।
তিনি বলেন, আমাদের যেহেতু আলাদা করে বসানো হতো সময়মতো পরীক্ষার খাতা প্রশ্ন হাতে পেতাম না। যেখানে অন্যদের প্রশ্ন দেয়ার পনেরো মিনিট আগে খাতা হাতে দিতো।
সেখানে আমাদের খাতা এবং প্রশ্ন দুটোই একই সাথে দিতো। অনেক সময় পরীক্ষা শুরুর দশ মিনিট পরেও দেয়া হতো। কিন্তু আমাদের জন্য অতিরিক্ত সময় দেয়া হতো না।
এছাড়া আমাদের মেয়েদের শ্রুতিলেখক খুঁজে পেতে অনেক কষ্ট হয়। যদি কোনোভাবে শ্রুতিলেখক নিবন্ধন ব্যবস্থা থাকতো তাহলে অনেক ভালো হতো আমাদের জন্য।
এইসব বিষয়গুলো ঠিক মতো হলে প্রতিবন্ধীদের আগ্রহটা আরো অনেকাংশে বেড়ে যাবে বলে মনে করেন নাজমা।
নাজমা বলেন, ইডেন কলেজে যোগ দেয়ার পর থেকে কলেজের অধ্যক্ষ, বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, সহকর্মী এবং স্টুডেন্ট সবাই আমাকে খুবই সহায়তা করেন এবং ভালোবাসেন।
ক্লাসের লেকচার অনলাইনের সহায়তায় নিজেই তৈরি করেন বলে জানালেন তিনি। নিজের মতো করে ক্লাসে সবাইকে পড়ান। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি বিভিন্ন সফটওয়্যারের সাহায্যে সবধরনের টেকনোলজির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত থাকেন তিনি।
নাজমা বলেন, এখনো অনলাইনে সব বই পড়া যায় না। আশা করছি এই সমস্যা অচিরেই সমাধান হয়ে যাবে। এছাড়া সমাজের মানুষ আমরা প্রতিবন্ধীদের নিজেদের সমকক্ষ হিসেবে ভাবতে চায় না।
আমি আরো পড়ালেখা করতে চাই। দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে চাই। থামতে চাই না। তবে এইসবের জন্য আমাদের চারপাশের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
নাজমা ইয়াসমিন বলেন, আমি আলো আর অন্ধকারের মধ্যে পার্থক্য অনুভব করতে পারি। এছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। তবে আমার দৃষ্টি না থাকলেও ছোট ছেলের চোখে পৃথিবী দেখি আমি। আমার সন্তানরা আমাকে খুব ভালোবাসে।
জীবনে চলার পথে শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক বেশি সহায়তা পেয়েছি। এছাড়াও কিছু বন্ধু আমাকে খুব সাহায্য করেছেন। আর বাবা-মায়ের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। কখনো অন্য ভাই বোনদের কাছ থেকে আলাদা ভাবেননি আমাকে। এভাবেই সবার ভালোবাসা নিয়ে পথ চলতে চাই। (এমজমিন)
: আপডেট, বাংলাদেশ ৯ : ০০ পিএম, ২৭ আগস্ট ২০১৭, রোববার
ডিএইচ