বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদী কেন্দ্র ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। শহরের ওয়ারল্যাস বাজার মোড় এলাকায় চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ১৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে চাঁদপুর নদী কেন্দ্র। দীর্ঘ ৩৫ বছর এ ইনস্টিটিউটে গবেষণা করে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাছের উন্নত জাতসহ প্রায় ২০ টি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে।
যা দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণে রাখছে অসামান্য অবদান। বিশেষ করে এ প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের নিরলস প্রচেষ্ঠার ফলে ২০ বছরে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।
হুমকির মুখে থাকা ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের গবেষকদের নিরলস গবেষণায় অল্প কয়েক বছরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিরল। বর্তমানে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল । ইলিশ গবেষণায় সফলতা পাওয়ার পাশাপাশি ২০১৭ সালে ইলিশের জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন সত্ত্ব লাভ করেছে বাংলাদেশ।
শুধু তা-ই নয়, নতুন নতুন পদ্ধতিতে মৎস্য চাষের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনেও কাজ করে চলছে এ প্রতিষ্ঠান। এ নদী কেন্দ্রে ৪০ টি স্থায়ী পুকুর, একটি হ্যাচারি এবং নদীতে জরিপকার্য ও পরীক্ষামূলকভাবে মাছধরার জন্য গবেষণা সরঞ্জামসহ একটি নৌযান রয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদী কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এখানে নদীর পানির মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র, টেকনোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও লিমানোলজিক্যাল ডিজিজ ল্যাব নামে একই সাথে তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ফলে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সদর দফতরসহ পাঁচটি কেন্দ্রের অন্যতম চাঁদপুর নদীকেন্দ্র।
চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের উপকেন্দ্র হিসেবে আরো দু’টি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো- রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত নদী উপকেন্দ্র রাঙ্গামাটি ও পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত নদী উপকেন্দ্র খেপুপাড়া।
চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের অধীনস্থ রাঙ্গামাটিস্থ নদী উপকেন্দ্র থেকে কাপ্তাই লেকে মৎস্যচাষ ও ব্যবস্থাপনা এবং খেপুপাড়াস্থ উপকেন্দ্র ইতে ইলিশ মাছের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন মৎস্য প্রজাতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে আসছে।
২০২০ সাল পর্যন্ত চাঁদপুর নদী কেন্দ্র গবেষণা করে মাছের উন্নত জাতসহ আধুনিক উপায়ে মাছ চাষের বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বিশেষ করে ইলিশ সম্পদ রক্ষায় যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এতে করে দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে ইলিশ মাছ।
চাঁদপুর নদী কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে-ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণের কৌশল ও ব্যবস্থাপনা,পুকুরে পাঙ্গাস চাষে একক ও মিশ্র চাষাবাদ প্রযুক্তি, থাই পাঙ্গাস চাষের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন, গৃহাঙ্গন হ্যাচারিতে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন,পুকুরে গলদা চিংড়ির একক ও মিশ্র চাষ, ধান ক্ষেতে মাছ চাষ, মাছ ও জলজ পরিবেশের ওপর কীটনাশকের বিষক্রিয়া নিরূপণ,কাপ্তাই হ্রদের জৈব ব্যবস্থাপনা ও জলাশয় তাত্ত্বিক সমীক্ষা, খাঁচায় তেলাপিয়া মাছ চাষ, নদ-নদীর পানির নবায়ন ও দূষণ বিষয়ক সমীক্ষা,ইলিশ মাছ গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা, পাঙ্গাস মাছের প্রতিপালন ও গবেষণা, থাই পাঙ্গাস মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ প্রমুখ।
এ সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয় এবং স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ ৫ম স্থান অর্জন করেছে।
সুত্র মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের সকল মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার মে.টন । যার মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ১৭ হাজার মে.টন। এরমধ্যে চাঁদপুর জেলায় ৫৬ হাজার ৯শ’৪৬ মে. টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় ৯৯ হাজার ৯শ ৮৭ মে. টন।
এছাড়াও দেশের মৎস্য ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চাঁদপুর নদী কেন্দ্র একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯৫ সালে থাই পাঙ্গাস মাছের পোনা উৎপাদনের জন্য রৌপ্যপদক, ২০১০ সালে রুই মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবনের জন্য স্বর্ণপদক এবং ২০১৮ সালে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখায় স্বর্ণপদক লাভ করে চাঁদপুর নদীকেন্দ্র।
ইতোমধ্যে ইলিশ উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং ‘সিটি অব হিলসা’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এমনকি দেশে সর্ব প্রথম থাই পাঙ্গাসের সফল প্রজনন, ইলিশ মাছের ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং খাঁচায় মাছ চাষ উদ্ভাবন করেছেন এ নদী কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।
মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য সম্পদ জরিপ পদ্ধতি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী,মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রম হাতে নেয়ার আগে ১৯৯৮-১৯৯৯ অর্থ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.১৪ লাখ মে.টন, ১৯৯৯-২০০০ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২.১৯ লাখ মে.টনে। ২০০০-২০০১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২.২৯ লাখ মে.টন, ২০০১-২০০২ অর্থবছরে উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ২.২ লাখ মে.টন এবং ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন আরো কমে দাঁড়ায় ১.৯৯ লাখ মে.টন।
পরবর্তীতে ২০০৭-০৮ অর্থ বছরে জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম হাতে নেয়ার পর থেকে প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ক্রমাগতভাবে। এসময় ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয় ৩.৫১ লাখ মে.টন, ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৮৫ লাখ মে.টনে, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৮৭ লাখ মে.টনে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩.৯৪ লাখ মে.টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয় ৫ লক্ষ মে.টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ইলিশের উৎপাদন এসে দাঁড়ায় ৫.১৭ লাখ মে. টনে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও দেশের একমাত্র ইলিশ গবেষক ড.মো.আনিছুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিনের গবেষণায় এ ইনস্টিটিউট বেশ ক’টি নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায় মৎস্য অধিদপ্তরসহ সকল স্টেক হোল্ডারদের অংশগ্রহণের কারণে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিই হয়নি আকারেও বড় হয়েছে। সুস্বাধু ইলিশ এখন নদীতে কমবেশি সারা বছরই পাওয়া যায় ।’
শরীফুল ইসলাম , ৪ ফেব্রুযারি ২০২০