শিক্ষা,শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের নিয়ে মোটা দাগে যে কটি দিন বা দিবস অনেকের বিশেষ করে শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত মানুষদের জানা,তা হলো ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস,১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস,৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এর সঙ্গে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবানুসারে ২০১৯ সাল থেকে যুক্ত হয়েছে ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস।
আজ ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে মহান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আমাদের স্বাধীন স্বদেশে শিক্ষায় নানা অর্জন ও করোনা-পরবর্তী কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনাকালে মাত্র মাস দু আগে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের প্রস্তাব ও সুপারিশসংবলিত নীতিনির্ধারণী বক্তব্যকে যথোচিত গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই।
এ বক্তব্যে তিনি বলেন, বৃহত্তর সামাজিক প্রতিবন্ধকগুলো ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে শিক্ষার অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কথা থাকলেও ন্যায্যতা ও প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কোনোভাবে নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণের উপযোগী নয়। প্রসঙ্গক্রমে তিনি দুটি সুপারিশ তুলে ধরেন।
এক. ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের লক্ষ্য সামনে রেখে গত বছর (২০২২) অনুষ্ঠিত শিক্ষার রূপান্তরসংক্রান্ত শীর্ষ বৈঠকের অঙ্গীকার পূরণে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভবিষ্যতের জন্য চুক্তিতে উপনীত হয়ে একটি নতুন শিক্ষাসমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন।
দুই. শিক্ষা ও জীবনব্যাপী শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়ে বৈশ্বিক জনকল্যাণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ফলপ্রসূ করতে শিক্ষার রূপান্তর তথা টেকসই উন্নয়নের চার নম্বর লক্ষ্য অর্জনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ।
একথা অনস্বীকার্য যে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের শিক্ষা নিয়ে ধারণার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরাধীন পাকিস্তানের শরিফ শিক্ষা কমিশনের গণবিরোধী প্রস্তাব ও মন্তব্যের বিরুদ্ধে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন সূচিত হয়। ওই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর নবকুমার স্কুলের ছাত্র বাবুল, বাস কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা ও গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লা শহিদ হন, তাতে বলা হয় :
‘শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয়, অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল ও নামমাত্র বেতনের মাধ্যমিক স্কুল স্থাপনে সরকারের ওপর নির্ভর করাই জনসাধারণের রীতি। তাদের উপলব্ধি করতে হবে, অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা অবাস্তব কল্পনা মাত্র।
’এর বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো প্রগতিশীল পদক্ষেপ লক্ষণীয়। যেমন-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ,প্রায় দু যুগ আগে প্রণীত কারিকুলাম সংস্কার, শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে ক্লাস শুরু,পরীক্ষার ফল প্রকাশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু,অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অনুকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষায় পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ, ছাত্রী উপবৃত্তির পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে দরিদ্র ছাত্রদের জন্য উপবৃত্তি চালু,জেন্ডারবৈষম্য হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ।
তবে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধের কথিত উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন হয়নি। এ রিপোর্টের মূল নির্যাস অক্ষুন্ণ রেখে প্রণীত ২০১০ সালের শিক্ষানীতিরও কাঙ্ক্ষিত পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।
২৭% প্রাথমিক বিদ্যালয় জরাজীর্ণ। বৃষ্টি হলেই পানি ঝরে ১৯% শ্রেণিকক্ষে। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও পদমর্যাদা দুটোই কম। দেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ % বহন করে পরিবার। চরাঞ্চলে উচ্চবিদ্যালয়ের সংকট ও প্রাথমিকে শিশু ঝরে পড়ে। প্রধান শিক্ষক ছাড়াই চলছে দেশের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়।
প্রাথমিক পরবর্তী মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিকে শিক্ষার ৯০ % সরকারি খাতবহির্ভূত। সেখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সবাই একই যোগ্যতার অধিকারী সরকারি শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের তুলনায় বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। শিক্ষার প্রায় প্রতিটি স্তর, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শ্রমবাজার থেকে বিচ্ছিন্ন।
দক্ষতা,সামাজিক মূল্যবোধ ও দেশাত্মবোধের উপাদান প্রচলিত শিক্ষায় কতটুকু আছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। খুদে শিক্ষার্থীদের কাঁধে বই-খাতা দিয়ে ভারী ব্যাগের বোঝা দেখা যায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে স্কুল-মাদ্রাসায় এবং নিজগৃহে শিশু শারীরিক শাস্তি মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ২০১৮ সালের মধ্যে ১:৩০ পৌঁছানোর কথা থাকলেও আজও তা ১:৩৮-এর নিচে নামেনি। এসএসসিতে শতভাগ শিক্ষার্থীর উত্তীর্ণ হওয়ার রেকর্ডধারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এ বছর একজনও পাশ করেনি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষার অনুকূলে বিবেচ্য বিষয়গুলো :
১. ইনচিয়ন ঘোষণার আলোকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মৌলিক শিক্ষার স্তর নির্ধারণ।
২. অতি কেন্দ্রীভূত বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাপনার (প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থায়নসহ) বিকেন্দ্রায়ন।
৩. শিক্ষার্থীর জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের পাঠ সম্ভব করে তুলতে অঞ্চল ও এলাকাভিত্তিক শিক্ষক বিনিময় ব্যবস্থা চালু।
৪. প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সময়সীমা হ্রাসের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা।
৫. ইউনেস্কো ঘোষিত ২০১৫ সালের শিক্ষকনীতি ও স্কুল নেতৃত্বসংক্রান্ত সুপারিশ সক্রিয় বিবেচনা।
৬. জনসংখ্যা এবং শিক্ষার্থীর অনুপাত ও দেশের প্রতিটি অঞ্চলকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ প্রদান এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত স্থানীয় সরকার অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ ও পৌরসভা/সিটি করপোরেশনগুলোকে শিক্ষায় অর্থায়নের উৎস হিসাবে পুনর্বিবেচনা।
৭. শিক্ষার্থীর জেন্ডারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পরিচালন ব্যবস্থার মূল্যায়ন ও সহশিক্ষার সমসাময়িক উপযোগিতা নির্ধারণ।
৮. কোচিং বাণিজ্য নিরসনে প্রতিকারমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন : যে কারণে ও পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হয়, তার অবসানকল্পে শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণে পশ্চাৎপদ শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার/সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত প্রতিকারমূলক (REMEDIAL) ও সমযোগ্যতা অর্জনে সহায়ক (LEVELLING) প্রতিষ্ঠান স্থাপনপূর্বক প্রচলিত কোচিং বাণিজ্যের নিরসন।
৯. শিক্ষায় করোনার পূর্বাপর পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন ও উত্তরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনুসৃত পন্থা, প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তি বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে ও অভিজ্ঞতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
মানবসভ্যতার স্তর বিশেষে জ্ঞানী ব্যক্তির দ্বারা জ্ঞান বিতরণ এবং তা গ্রহণকারীর/শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে এ প্রক্রিয়া স্থানীয় ও প্রাতিষ্ঠানীকরণে রূপান্তরিত হয়। কয়েক শতাব্দীর বিবর্তনে বিগত দুই যুগের বেশি সময়ে শিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণ লক্ষণীয়।
বর্তমানে কাম্য দক্ষতা অর্জন জীবন ও জীবিকার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ইতঃপূর্বে প্রচলিত ‘জ্ঞানের জন্য জ্ঞান’ অর্জনের শিক্ষা এখন সাবলীল জীবনযাপন ও কাম্য উন্নত জীবিকা অর্জনের উপযোগী মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) এবং সর্বশেষ ২০১৫-এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) বাংলাদেশের অর্জন উল্লেখযোগ্য হলেও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব পরিসরে সমযোগ্যতার ভিত্তিতে সমকক্ষতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
সেজন্য শিক্ষার সময়ানুগ উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হিসাবে বিরাজিত বিষয়গুলো চিহ্নিতকরণ ও উত্তরণের পথনির্দেশনা এবারের শিক্ষা দিবসে যেমন প্রাসঙ্গিক, শিক্ষায় নানামুখী প্রবণতার মূল্যায়নও জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে দেশে বাণিজ্য শিক্ষায় শিক্ষার্থীর আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে, কারিগরি শিক্ষায় নানামুখী সুযোগ-সুবিধা দিয়েও শিক্ষার্থী বাড়ানো যাচ্ছে না।
এমনকি শিক্ষা বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়ছে না শিক্ষার্থীর সংখ্যা। তথ্যপ্রযুক্তি আয়ত্তে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবার ক্রমবর্ধমান দক্ষতা, করোনাকালে ও পরবর্তীকালে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, অনলাইন-অফলাইন উভয় পন্থায় শিক্ষাদানের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শিক্ষায় অব্যাহত গতিময়তা নতুন ধারা ও ধারণায় উত্তরোত্তর বিকশিত হোক। এবারের শিক্ষা দিবসে কায়মনোবাক্যে তাই হোক সবার প্রত্যাশা।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০- প্রণয়ন কমিটির সদস্য