ফিচার

১৪ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো কথা হয় না!

সেদিন এক রোগী দেখলাম। প্রবলেম মাথা ব্যথা আর মন খারাপ। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন। সিটি, এমআরআইসহ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঢাকা থেকে বহু আগে করিয়েছেন। সব কিছুই নরমাল। ওষুধ খাচ্ছেন ডাক্তারের পরামর্শ মেনে। তাও সমস্যার কোনও উপশম নেই। যায়, আবার ফিরে আসে।

নিউরোমেডিসিন স্পেশালিস্ট এক বড় ভাই বুঝিয়ে শুনিয়ে রেফার্ড করে পাঠালেন। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আসতে চায়নি। ভার্সিটির বন্ধুবান্ধব কী বলবে। সে কি পাগল নাকি। আমাদের সমাজে এখনো প্রচলিত ধারণা, ঘোরতর পাগল হলেই কেবল সাইকিয়াট্রিস্ট কাছে নিয়ে যেতে হয়। এর আগে পরিবার, সমাজ, সংসার তছনছ হয়ে সব চুলোয় যাক।

যাইহোক কথা বলতে বলতে, কারণ হিসেবে বহুক্ষণ পর জানলাম তার মা বাবা গত ১৫ বছর যাবৎ সেপারেশন এ থাকেন। একই ছাদের তাদের বসবাস কিন্তু আলাদা আলাদা রুমে। স্বামী-স্ত্রী তারা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না….।

কিন্তু সমস্যা হয়ে যাচ্ছে বাচ্চাগুলোর। অবাক হচ্ছেন.., অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? হ্যাঁ। আমিও অবাক হয়েছিলাম শুনে।

পরে জানলাম এক বিন্দুও মিথ্যে নয়।

বললাম চিকিৎসা তো তোমার মা বাবার দরকার।

সেও মাথা নেড়ে ‘হ্যা’ বলল।

‘তাহলে নিয়ে এসো একদিন, গল্প করি সবাই মিলে। দেখি প্রবলেম গুলো কোথায়…’।

ও বলল, ‘একবার বাবাকে বলেছিলাম, ‘বাবা, তোমরা দুজন মেন্টালী সিক। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও..’

বাবা চড় মেরে আমাকে বলেছিলো, ‘বেশি পেকেছিস। আমি কি পাগল? তর মা একটা পাগল। তোর মায়ের গোষ্ঠীশুদ্ধ পাগল। তোর মা কে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা..”

‘মাকে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বললাম। মা বাবা রাগ হলেই আমাদের মারে কেনো…?’

মা বললো, ‘কাঁদিস না। দেখিস না গত ১৫ বছর আমি কাঁদি না। কথা ও বলিনা, থাকিও না লোকটার সঙ্গে। মেন্টালি সিক একটা লোক…’

মেয়েটি লজ্জা পাচ্ছিলো। বললাম, ‘লজ্জার কিছু নেই। উন্নত বিশ্বে সচেতন নাগরিক ফ্যামিলিতে এসব কনফ্লিক্ট দেখা দিলে সাইকিয়াট্রিক কাউনসেলিং নেয় তারা। আমাদের দেশে শিক্ষা সচেতনতা কম। তুমি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে এসেছো, তোমাকে ধন্যবাদ। তবে ডাক্তারের কাছে কিছু লুকাতে নেই…’

সে তার ফ্যামিলির পুরো হিস্ট্রি খুলে বললো। সে এক করুণ কাহিনী!

দুই.

বহু আগের কথা। সে তখন খুব ছোট। তিন বোনের পর এক ভাই হয় তাদের। ভাইটি খুব কাঙ্ক্ষিত ছিল তাদের উভয় পরিবারের জন্য। ভাইটি ছিল চাঁদের টুকরোর মতো দেখতে। ওর যখন ছ’মাস বয়স তখন ভাইসহ নানাবাড়ি বেড়াতে যান মা। কী এক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে। নানাবাড়িতেই হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে মারা যায় তাদের বংশের প্রদীপ, একমাত্র ভাই!

তারপর থেকেই দোষাদোষ। বাবা দোষী করে মাকে আর নানাবাড়ির সবাইকে। তার অভিযোগ সন্দেহের তীর নানাবাড়ির সবার দিকে। নানা বাড়িতে বেড়ানো যাওয়াটাই কাল হয়েছে। তারাই মেরেছে, চিকিৎসায় অবহেলা করেছে।

আর মা দোষী করেন বাবাকে। নিশ্চয়ই এটা বাবার পরিবারের কোনো না কোনো কুকর্মের ফল।

এ নিয়ে রোজ রোজ স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য, কথা কাটাকাটি, গালিগালাজ, ব্যাগ গুছাগুছি, এমনকি হাত তোলা পর্যন্ত। অবশেষে লোকলজ্জার ভয়ে প্রকাশ্যে তাদের ডিভোর্স হয়নি। কিন্তু চলছে সেপারেশন লাইফ। গত ১৫ বছর ধরে এভাবে লোক দেখানো সম্পর্ক।

‘আমার তো বিশ্বস হয় না। এক বাড়িতে, একই ছাদের নীচে থাকেন তোমার মা বাবা, অথচ তারা একে অপরের সাথে কথা বলে না!’

‘হ্যাঁ, স্যার কথা বলে না তারা। বাবার কিছু লাগলে বাবা আমাদের ধমক দিয়ে বলেন, ‘এই যাহ তোর মাকে বল এটা লাগবে….’।

‘আর মার কিছু লাগলে…?’, আমি জিজ্ঞাস করলাম।

মা ও একই। ধমক দিয়ে বলেন, “যাহ তর বাপকে গিয়ে বল আজ কি কিছু খাবে না নাকি…”

কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটির দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো,

‘স্যার পৃথিবীতে মা আর বাবা পাশে বসে হেসে হেসে দুটো কথা বলতে পারে, এটা আমরা কখনো দেখিনি!’

তিন.

মাথা ব্যাথা, আর মন খারাপ নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে চেম্বারে বছরের পর বছর ধর্না দেয়া অনার্স পড়ুয়া মেয়েটির বাবা একজন উচ্চপদস্থ বেসরকারি কর্মকর্তা, আর মা ব্যাংকার। কিন্তু তারা দুজনেই মানসিক রোগে জর্জরিত। তাদেরতো জীবন তো শেষ হলোই এখন তার প্রভাব পড়ছে সন্তানদের ওপর।

ডা. সাঈদ এনাম, সাইকিয়াট্রিস্ট ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও প প কর্মকর্তা।

Share