Home / সারাদেশ / ‘১২ বছর ধরে আমাকে কেউ মা বলে ডাকে না’
১২ বছর ধরে আমাকে কেউ মা বলে ডাকে না

‘১২ বছর ধরে আমাকে কেউ মা বলে ডাকে না’

‎Monday, ‎May ‎11, ‎2015  01:25:49 AM

চাঁদপুর টাইমস ডট কম:

রাজধানী আগারগাঁও প্রবীণ নিবাস ভবনের চতুর্থ তলার বারান্দায় বিষন্ন মনে একাকি বসে আছেন বৃদ্ধা এক মা। বয়স ৭০ কী ৭৫ হবে।

অশ্রুভরা ছলছল দুটি চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।

সেই বৃদ্ধা মায়ের পাশে বসে জানতে চাইলাম মা কেমন আছেন? মা ডাকটি শুনতেই যেন আতকে উঠলেন তিনি। অনেকক্ষণ তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি? এখানে কী চাও?

সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে তার প্রশ্নের জবাবে বললাম, মা আপনার খোঁজ নিতে এসেছি। তখন তার কোমল হাত দিয়ে আমার মাথায় আদর করে বললেন, জানো বাবা তোমার মতো আমার একটি ছেলে আছে। কিন্তু ১২ বছর ধরে সে আমাকে মা বলে ডাকে না। মা ডাকটি অনেক দিন শুনিনি।

মে মাসের দ্বিতীয় রোববার (১০ মে) বিশ্ব মা দিবসে আগারগাঁওয়ের বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মায়েদের খোঁজ নিতে সরেজমিনে গিয়ে এমন নিষ্ঠুর অনুভূতি কথা জানা যায়।
এখানে কতদিন ধরে আছেন, কেন এখানে আসতে হলো, একমাত্র ছেলে কোথায়, কী করছেন?

এমন সব প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ওই বৃদ্ধা বললেন, আমার ছেলে অনেক ভালো আছে। তার সংসার টাকা-পয়সা সব কিছু নিয়ে সে ভালোই আছে। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস কারো না বাবা।

আমার নাম জানতে চেয়ো না। তার (ছেলে) নামও জানার চেষ্টা করো না। আমার জন্যে সে সমাজে ছোট হোক তা আমি কোনো দিন চাই না। প্লিজ তুমি চলে যাও। পুরোনো কথা মনে করতে বলো না। বললেন-তিনি।

আগারগাঁও এই বৃদ্ধাশ্রমে এমন অনেক মা-বাবা রয়েছেন। যাদের আদরের ছোট্ট সেই খোকা বা খুকিরা বড় হয়ে টাকা-পয়সা, নিজের স্ত্রী-সন্তান এবং সংসারের টানে মমতাময়ী মা-বাবাকে সব কিছু থেকে ছিন্ন করে চার দেয়ালের এই বৃদ্ধাশ্রমে একা রেখে গেছেন।

যে বয়সে তাদের ছেলেমেয়ে, পুত্রবধ‍ূ এবং নাতি-নাতনির সঙ্গে আনন্দে সময় কাটানো কথা তখন তারা অন্ধকার ছোট্ট একটি কক্ষে কেঁদে কেঁদে একাকি দিন অতিবাহিত করছেন।

এবার বারান্দায় বসা বৃদ্ধা এই মাকে ছেড়ে ৪১৫ নম্বর কক্ষের দিকে পা বাড়াই। দরজার সামনে পা রাখতেই যন্ত্রণায় কাতরানোর শব্দ শোনা গেল।

অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে জানা গেল, মিরা চৌধুরী (৬৫) দু’বছর ধরে পা ভাঙার যন্ত্রণায় ভুগছেন। একদিন বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেন। ওই কক্ষটিতে ৪ বছর ধরে আছেন তিনি।

মিরা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে শিক্ষকতা শুরু করেন। পেশাজীবনে খুলনা কলেজে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিলেও ব্যক্তিগত কারণে অবসরে যান।

ঢাকায় বর্তমানে তার দেখাশুনা করার মতো কেউ নেই। সংসারে স্বামী আর এক ছেলে ছিল। স্বামী অনেক আগে মারা গেছেন। ছেলে অপূর্ব হাসান চৌধুরী পড়াশুনার জন্য আমেরিকায় থাকেন।

তবে বৃদ্ধাশ্রমে আসার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ তিনি বলেননি। ছেলে খোঁজ-খবর নেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ খোঁজ-খবর নেয়। তার সময় হলে সে ফোন করে। কেমন আছি, বেঁচে আছি কি না এই খোঁজটুকু নেয়।
পা ভাঙার জন্য ডাক্তার দেখিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কে নিবে আমাকে ডাক্তারের কাছে?

বৃদ্ধাশ্রমের খাবার-দাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে চোখ কপালে তুলে মিরা চৌধুরী বলেন, এখানকার খাবার-দাবার! চিড়িয়াখানার পশু-পাখিও আমাদের চেয়ে ভালো খাবার খায়। খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাই খাই।

চার তলা পেরিয়ে পঞ্চম তলায় ৫১৫ নম্বর কক্ষের দরজায় কড়া নাড়া হলো। কিন্তু কোনো সাড়া মিললো না।

শুধু ভেতরে বিদগুটে অন্ধকারে ফ্যানের পাখার শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওই কক্ষের ভেতরে ঢোকার সুযোগ হলো। দেখি ৬০ কিংবা ৬৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা পুরানো একটি ইজি চেয়ারে নিশ্চুপ বসে আছেন। চোখ মেলে জানতে চাইলেন আপনি কে, কেন আসলেন এখানে?

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, বাবা তোমরা মা দিবস আসলে শুধু এই মায়েদের মনে করো, আর সারা বছর তোমরা কোনো খোঁজ নাও না। তোমরা সব সন্তান নিষ্ঠুর।

কী হবে পত্রিকায় আমাদের এই কথা ছেপে। আবেগটাই তো শুধু জানেত পারবে আর কিছু না। চলে যাও বাবা, কথা বলে বিরক্ত করো না। -বললেন ওই বৃদ্ধা।
শুধু বৃদ্ধাশ্রমে নয় এই সমাজের রাস্তা-ঘাটেও থাকেন অসংখ্য মা। যাদের সন্তানরা মাতৃত্বের বাঁধন ছিন্ন করে চলে গছেন দূরে। ভুলে গেছে মমতাময়ী মায়ের আদর-ভালোবাসা।

এমনই এক মাকে খুঁজে পাওয়া যায় তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তিতে। তার নাম ফুলবানু। বয়স কত হবে জানা নেই তার। বাড়ি টাঙ্গাইল। স্বামীসহ দুই ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার ছিল। গ্রামের বাড়িতে ভিটেমাটি সবই আছে। কিন্তু ঠাঁই নেই তার।

স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই ছেলেকেই বিয়ে করান ফুলবানু। বিয়ের পর দুই পুত্রবধূর কাছে বিরক্তিকর মানুষ হয়ে উঠলেন বুড়ো মা।

তিনি কাজ ছাড়া শুয়ে-বসে খাবেন তা মেনে নিতে পারছিলেন না পুত্রবধূসহ দুই ছেলে। তাই তারা বাড়ি থেকে বের করে দেন ফুলবানুকে।

খেয়ে পড়ে বাকি জীবন বেঁচে থাকার জন্যে ঢাকায় পাড়ি জমান তিনি। প্রায় ৮ বছর ধরে তিনি এখানে থাকেন। ভিক্ষা করে নিজের পেট নিজেই চালান।

ছেলেরা কোনো খোঁজখবর নেন কি না জানতে চাইলে মাথা নেড়ে না করেন। আর বাড়ি ফিরবেন কি ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বাড়ি-ঘর সব এখন এই বস্তিই। আমার লাইগ্যা পোলাদেরও ( ছেলেদের) সমস্যা অয় (হয়)। এইহ্যানে (এখানে) ভিক্ষা কইরা নিজে খাই, কারু সমস্যা অয় (হয়) না। কেউ আমারে মারবার লাইগ্যাও আহে (আসে) না।

চাঁদপুর টাইমস/ডিএইচ/2015