Home / সারাদেশ / ১২ জুন আর্ন্তজাতিক শিশু নিরসন দিবস
১২ জুন আর্ন্তজাতিক শিশু নিরসন দিবস

১২ জুন আর্ন্তজাতিক শিশু নিরসন দিবস

বুধবার, ১০ জুন ২০১৫ ০৭:৫৫ অপরাহ্ন

আবদুল গনি :

১২ জুন আর্ন্তজাতিক শিশু নিরসন দিবস। পৃথিবীর প্রায় ১৯৪ টি দেশে এ দিবসটি শিশু শ্রম নিরসনের লক্ষ্যে গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের বিভিন্নমুখী সমস্যাগুলোর মধ্যে শিশুশ্রম একটি। মূলত দারিদ্রতার কষাঘাত থেকে এর উৎপত্তি। শিশুরা আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ ও মানবসম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। সমাজের উন্নয়নে শিশু শ্রম একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশ একদিকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে সমাজ তার ভবিষ্যৎ সৃষ্টিশীল প্রতিভার অংশদারিত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের উচিত।

শিশু অধিকার সনদ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০ নভেম্বর, ১৯৮৯- এর রেজুলেশন ৪৪/২৫ দ্বারা স্বাক্ষর, অনুসমর্থন, অনুমোদনের জন্য গৃহীত এবং উন্মুক্ত করা হয়। অনুচ্ছেদ-৪৯ অনুসারে এটি ১৯৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর কার্যকর হয়। এ পর্যন্ত ১৯৪টি দেশ এ কনভেনশনে অনুসমর্থন করে। বিশে^র প্রথম যে ২২টি দেশ সনদটি অনুসমর্থন করে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এ সনদটি কার্যকর করা হয়। ১৯৯১-২০১৫ পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর ধরে শিশু সনদটি বাংলাদেশে অনুশীলন হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এখনও শিশু বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।

শিশুদের প্রতি আচরণগত দিকগুলো শ্রেণিভেদে ভিন্নতা রয়েছে। সম্পদের প্রাচুর্যের পরিমাণ গত পরিমাপের পারিবারিক অবস্থানে জন্ম নেয়া হিসাবে একটি তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদশে শিশু অধিকার ফোরাম। তাদের তথ্যমতে, ৩২ লাখ শিশু সাধারণ শ্রমে নিয়োজিত আর বাকিরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। এ তথ্য- উপাত্তটি শ্রমজীবী শিশুদের একটি পরিসংখ্যান মাত্র। বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে শিশুদের শ্রমমুক্ত করতে বিভিন্ন ধরনের স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কৌশল এবং কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু পরোক্ষভাবে শিশু শ্রমে যে শিশুরা নিয়োজিত আছে তাদের নিয়ে সরকারি কোনো প্রকার কর্মসূচি আছে কি না তা বুঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর বস্তি এলাকার দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের ভরণপোষণ দিতে না পারায়, তারা তাদের সন্তানদের বিভিন্ন আবাসিক মাদ্রাসায়, লিল্লাহ বোর্ডিং, এতিমখানায় ভর্তি করে দেয়। এখানে শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে অধ্যয়নরত শিশুদের বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত করে থাকে। বাংলাদেশের শহর, বন্দর এবং গ্রামে যেসব লিল্লাহ বোর্ডিং, মাদ্রাসা ও এতিমখানা রয়েছে, এগুলো জনসাধারণের দানে পরিচালিত হয়।

এ প্রতিষ্ঠানগুলো অধ্যয়নরত শিশুদেরও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ঈদের সময় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত শিশুদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে বিভিন্ন বাড়িতে কোরবানির চামড়া, ফেতরা এবং যাকাতের টাকা প্রতিষ্ঠানের জন্য সংগ্রহ করতে দেখা যায়। আর এভাবেই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য অর্থ শিশুরা সংগ্রহ করে থাকে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য করার মতো, তা হলো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু শ্রমের বিনিময়ে আহরিত অর্থ ব্যয়ের কর্তৃত্ব তার কাছেই থাকে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ২৯ অনুচ্ছেদের উপধারায় বর্ণিত আছে যে, সনদ অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রে শিক্ষার যে বিষয়গুলো লক্ষ্য থাকবে তা হচ্ছে- ‘শিশুর মেধা এবং মানসিক শারীরিক ও দক্ষতার পূর্ণ বিকাশ।

বিশ^ শিশু নিরসন দিবসে শুধু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের শ্রম নিরসনের কথা ভাবলেই চলবে না। সে সঙ্গে শ্রমভিত্তিক কর্মকা-ে নিয়োজিত শিশুদের নিয়েও সরকার ও বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) নতুন করে কর্মকৌশল প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ১৯৯৪ সালে আইএলও এবং ইউনিসেফ পরিচালিত র‌্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট অব চাইল্ড লেবার সিচুয়েশনইন বাংলাদেশ জরিপে বাংলাদেশের প্রায় ৪৩৮ ধরনের অর্থনৈতিক খাতে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। এর মধ্যে পুরাতন জেলা শহরে ১৮৭, থানা সদরে ১৩৩, পার্বত্য এলাকায় ২৩ এবং পল্লী এলাকার ৯৫ ধরনের খাতে শিশুরা শ্রম প্রদান করছে। দেশের মোট শ্রমজীবী শিশুদের মধ্যে শতকরা ৬৬ ভাগ নিয়োজিত রয়েছে কৃষিখাতে।

নিয়োজিত শিশুরা কৃষির বিভিন্ন খাত যেমন – চিংড়ি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাছ ধরার জাল তৈরী, কামার , পাথর ভাঙ্গা, মাটির পাতিল তৈরী, চিংড়ি মাছের পোনা ধরা, শামুক ভাঙ্গা, এবং শামুক সংগ্রহসহ জুম চাষে নিয়োজিত রয়েছে। এসব খাতে নিয়োজিত শিশুরা বিৃিভন্ন সময়ে মারাতœক জটিল রোগে আক্রান্ত ও দুর্ঘটনার স্বীকার হয়। কাজ – ভেদে আক্রান্ত রোগের মধ্যে রয়েছে – হাতে পায়ে ঘা, শরীরে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, হাতে পায়ে ক্ষত, নিউমোনিয়া, হাত-পা কামড়ানো, জ্বর, হাত ভেঙ্গে যাওয়া, গ্রন্থিবাত, দৈহিক গঠনে বাধা, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি, হার্নিয়া, এলার্জির কারণে হাত ফুলে যাওয়া, সাপ বা বিষাক্ত পোকারকামড়ে অনেকসময় প্রাণ দিতে হয়, বুকেব্যথা, এজমা, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, সাইনোসাইটিস, হাইড্রোসিল ইত্যাদি। শিশুরা শিল্পের যে খাতগুলোতে শ্রম দিচ্ছে তা হচ্ছে গার্মেন্টস কনস্ট্রাকশন, ইলেকট্রিক মেকানিক ফ্লাওয়ার মিল, গ্যাস বার্নার, মেকানিক প্রিন্টিং প্রেস, স’মিল ওয়েলড্রিং, গ্লাস, সিরামিক, ফোম, চিংড়ি, প্লাস্টিক, রাবার, ট্যানারী, কার্পেট, ম্যাচ, স্টিল রি- রোলি মিল অটো মোবাইল ওয়ার্কসপ বেকারী, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ, লেদ ওয়ার্কসপ, বিড়ি, বেঙ্গলস, স্বর্ণকার , অ্যালুমিনিয়াম, কার্পেন্টার, ধান- পাট মিল, সাবান, লবণ, তৈল মিল, স্টেইনলেস মিল, ইটের ভাটা, রিক্সা হুড বানানো, কাঁচি শিল্প, ডক ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙ্গা ইত্যাদি কলকারখানায় শিশুরা শ্রম বিনিময় করছে। এতে শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

এর মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের পীড়া, কাশি, নিউমোনিয়া, আলসার, ট্রমাটাইস, যক্ষা, এজমা, ওজন হ্রাস, হাত ও পায়ের আঙ্গুল ভেঙ্গে যাওয়া, হাঁপানি, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস, ধনুস্ট্রংকার, গিটাবাত, হার্ণিয়া, শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট, চোখের সমস্যা মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, নখের ক্ষত, বমি ও শক্তির লোপ ইত্যাদি।

দেশে মোট শ্রমজীবী শিশুদের শতকার ১০ ভাগ শিশু। শিশুরা যে সকল বিভিন্ন উপখাতে কাজ করে তা হলো আয়ার কাজ, সুইপারের কাজ, হোটেল রান্নার কাজ, জামা ইস্ত্রি, টোকাই, কাঠ মিস্ত্রি, উইভিং ওয়ারকার, কুলি, গরু-ছাগল, জবাই ও কাটার কাজ প্রভৃতি।

এ সকল কাজে শিশুরা জড়িত থাকায় তারা সর্দি-কাশি, জ্বর, মাথাব্যথা, নিউমোনিয়া, আগুন পোড়া, ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস, কফ, শ্বাসকষ্ট, চুলকানি, চামড়ার ক্ষত, শরীরের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, ফুলেউঠা, ঘাড়ের যন্ত্রনা, কালাজ্বর, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

দেশে শিশুশ্রম নিরসনে জাতিসংঘ কর্তৃক শিশু সনদ ও দেশের প্রচলিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এসব শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব। বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দরিদ্রতার হার বর্তমানে ২৫ ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে শূন্যের কোঠায় নামানোর জন্য সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন জরুরি।

আমরা আশাকরি দরিদ্রতার হার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলে শিশুশ্রমের হারও কমে আসবে। সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের এক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে এবং তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার প্রতি আরো বেশি মনোযোগ হলে শিশুশ্রম অবশ্যই কমে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫

চাঁদপুর টাইমসর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না