চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত ফরিদগঞ্জের গুপ্টি-পশ্চিম ইউনিয়নের খাজুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো.খোরশেদ আলম ভূঁইয়া (৫৫)। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার চার সদস্যের সংসার। তিনি তার পৈত্রিক বাড়িতে থাকেন। এলাকায় ফার্মেসী দিয়ে সংসার চালান তিনি । সংসার তার ভালোই চলে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, খোরশেদ আলম ভূঁইয়ার কাছে এলাকার রফিকুল ইসলামকে বলেন ‘ভাই খুব দুঃখ-কষ্টে জীবন-যাপন করছি। যদি পারেন আমার জন্য কিছু একটা করেন।’ তার দারিদ্রতার কথা চিন্তা করে খোরশেদ আলম তাকে একটি গরু কিনে বর্গা দিয়ে পালতে বললেন। সে খুশিতে রাজি হয়ে যায় এবং ১৯ হাজার টাকা মূল্যে একটি গরু কিনে দেন। কিন্তু কিছুদিন পর খোরশেদ আলম খবর পায় যে, রফিকুল ইসলাম গরুটি বিক্রি করে দিয়েছে। খোরশেদ আলম বার বার গরু ফেরত চাইলেও রফিকুল ইসলাম গরু ফেরত দিতে অস্বীকার করে। প্রতিবেশিকে উপকার করতে গিয়ে তিনি বিপদে পড়েন। এ নিয়ে খোরশেদ আলম এলাকায় অনেক শালিস-দরবারের দ্বারস্থ হয়েছেন কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি।
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জানেন। বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইউএনডিপি -এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ জনগোষ্ঠী স্বল্প সময়ে ও অতি অল্প খরচে ন্যায়-বিচার পাবেন। এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গ্রাম আদালত বিষয়ক উঠান-সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এরূপ একটি উঠান-সভায় খোরশেদ আলম অংশগ্রহণ করেন। উক্ত উঠান-সভায় গ্রাম আদালত কি , গ্রাম আদালতের এখতিয়ার ও কোন কোন বিষয়ে গ্রাম আদালত বিচার করতে পারবে তা নিয়ে আলোচনা হয়। উঠান-সভার শেষে খোরশেদ আলম গ্রাম আদালত সহকারী সীমা রাণী দাসকে বলেন, “আপা, আমার এ ঘটনার কি কোনো বিচার পেতে পারি? আদালত সহকারী বলেন,‘এটি গ্রাম আদালতের এখতিয়ারভুক্ত একটি মামলা। আপনি চাইলে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন।’
অতপর খোরশেদ আলম গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করতে গুপ্টি-পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদে আসেন এবং গ্রাম আদালত সহকারীর সাথে আলোচনা করার পর গ্রাম আদালতে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আদালত সহকারীর সহায়তায় মাত্র ১০ ফিস দিয়ে তার ১৯ হাজার টাকা মূল্যের বর্গাকৃত গরু ফেরত পাওয়ার দাবিতে তিনি যথাক্রমে রফিকুল ইসলাম ও লিলু বেগমের বিরুদ্ধে ৪ আগস্ট ২০১৮ একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন।
মামলাটি আদালতের মামলা রেজিস্টারে ১৬/২০১৮ নং মামলা হিসেবে নথিভূক্ত করা হয়। ঐ দিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. শরীফ গাজাী যথানিয়মে প্রতিবাদীগণের প্রতি সমন জারি করার আদেশ দেন। আদালত সহকারী গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে প্রতিবাদীগণের প্রতি সমন জারি করেন। সমন পাওয়ার পর ১১ আগস্ট ২০১৮ তারিখে প্রতিবাদীগণ ও আবেদনকারী উভয়ই হাজির হন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. শরীফ গাজী প্রতিবাদীগণকে আবেদনকারীর অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত করলে প্রতিবাদীগণ তা’অস্বীকার করায় পক্ষদ্ধয়কে আদালত গঠন করার জন্য সদস্য মনোনয়ন করার নির্দেশ দেন। গ্রাম আদালত সহকারী তাদেরকে সদস্য মনোনয়ন ফরম দিয়ে সদস্য মনোনয়নের বিষয়টি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেন।
১৬ আগস্ট ২০১৮ তারিখে আবেদনকারীর পক্ষে ১) মো. শাহ আলম কিরণ, ইউপি সদস্য, ২) মো. বজলুর রহমান, স্থানীয় ব্যক্তি এবং প্রতিবাদীর পক্ষে ১) মো. মাসুদ আলম, ইউপি সদস্য, ২) মো. কামরুল হাসান, স্থানীয় ব্যক্তিকে গ্রাম আদালতের বিচারক হিসেবে মনোনীত করেন। তারপর চেয়াম্যান মহোদয় ১৯ আগস্ট ২০১৮ তারিখের মধ্যে প্রতিবাদীকে লিখিত আপত্তি ও ২২ আগস্ট ২০১৮ প্রথম শুনানীর জন্য দিন ধার্য করেন।
মামলার শুনানীর দিন তারিখ ছিল ২২ আগস্ট ২০১৮ । উভয় পক্ষ ও গ্রাম আদালতের মনোনীত সদস্যগণ হাজির হন। উভয় পক্ষ তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এরপর আদালত কর্তৃক বিচারিক বিষয় নির্ধারণ হয় যে, মো. খোরশেদ আলম ভূঁইয়ার বর্গা দেয়া গরুটি মো. রফিকুল ইসলাম বিক্রি করে দিয়েছেন। অত:পর পক্ষদ্বয়কে প্রাক-বিচারের মাধ্যমে মামলা নিস্পত্তির বিষয়টি অবহিত করলে পক্ষদ্বয় সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
মামলার রায় হলো ২৮ আগস্ট ২০১৮ । পক্ষদ্বয় আপোষনামা জমা দেয়ায় আপোষনামার শর্ত অনুযায়ী গ্রাম আদালত রায় প্রদান করে যে, প্রতিবাদী আবেদনকারীকে ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখের মধ্যে গরু ফেরত দিবেন এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এ ধরণের কাজ করবেন না। উপকারীর অপকার করবেন না।
এরপর আদালতের রায় অনুযায়ী ১ আগস্ট ২০১৮ প্রতিবাদী রফিকুল ইসলাম আবেদনকারী খোরশেদ আলম ভূঁইয়াকে ১৯ হাজার টাকা মূল্যের বর্গাকৃত গরুটি স¦সম্মানে ফেরত দেন। মাত্র ১০ টাকা মামলা ফি প্রদান সাপেক্ষে ৬ দিনের মধ্যে বিচার-কার্য সম্পন্ন হয় এবং ৪ দিনের মধ্যে আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা হয়।
সম্পাদনা : আবদুল গনি
১২ নভেম্বর ,২০১৮ সোমবার