সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের কোন হাত নেই বলে মনে করেছেন ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিষ্ট অতীন দাশ।
উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক যুগশঙ্খে বৃহস্পতিবার এক কলামে তিনি এ কথা লিখেছেন।
অতীন দাশ লিখেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিএনপি এবং জামায়াতের হাত রয়েছে বলে সরকারি দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি বা জামায়াতের পক্ষে এ ধরণের কাজে লিপ্ত হওয়ার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। কারণ এই দুই দল সরকারি দলের সাঁড়াশি আক্রমণে নিজেদের আস্তিত্ব নিয়েই বিপদে পড়েছে।
গুপ্তহত্যা বা হিন্দুদের উপর আক্রমণের যখনই কোনও ঘটনা ঘটে তখনই ইসলামিক স্টেটের পক্ষ থেকে এর দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বার বার দাবি জানানো হচ্ছে যে বাংলাদেশে আইএস-এর কোনও আস্তিত্ব নেই। তা হলে এ সব কে বা কারা ঘটাচ্ছে?
তিনি লিখেছেন, সরকারের পক্ষে আজ পর্যন্ত একটি গুপ্তহত্যা বা সংখ্যালগুদের উপর আক্রমণের ঘটনায় একজন অপরাধীকেও আদলতে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়নি। প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রকৃত দোষীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। সম্প্রতি অধ্যাপক রিপন চক্রবর্তীর উপর আক্রমণের ঘটনায় একজন আততায়ীকে জনসাধারণ হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয়, পুলিশ তাকে জিম্মায় নেওয়ার পর ধৃত দুষ্কৃতীটি সংঘর্ষে নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়।
এ ঘটনা খুবই অবিশ্বাস্য। যাকে জেরা করে অনেক কিছু জানার অবকাশ ছিল তাকে এ ভাবে হত্যা করার পেছনে কী রহস্য রয়েছে সে নিয়ে জোর বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এ সব আক্রমণের পেছনে কারা জড়িত তা প্রকাশ না হওয়ার জন্যেই ধৃতদের ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা করা হচ্ছে বলে যে সন্দেহ এই ঘটনা সেই অভিযোগকেই পুষ্ট করছে।
দীর্ঘদিন দ্বায়িত্ব পালন করা যুগশঙ্খের সাবেক এই সম্পাদক তার কলামে লিখেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতন এমন এক পর্যায় পৌঁছেছে যা অতীতের সমস্ত রেকর্ডই স্লান করে দিয়েছে। এই অত্যাচারের পেছনে রাষ্ট্র্রশক্তির প্রশ্রয় এবং যোগসাজশ থাকায় কখনও এর অবসান ঘটবে না, এবং ইসলামিক রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী অমুসলিমদের নিঃশেষ না করা পর্যন্ত এই অভিযান চলতেই থাকবে।
পাকিস্তান প্রায় সেই লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং শিখদের আনুপাতিক হার এখন দশমিকে উল্লেখ্য। বাংলাদেশে এই প্রয়াস এখন জোর গতি পেয়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় হাসিনা না খালেদা, এতে তেমন কোনও তারতম্য ঘটবে না।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যাঁরা শহিদ বা পাকিস্তান বাহিনীর অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছিলেন, সংখ্যার অনুপাতে হিন্দুরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ, স্বাধীনতার মূল্য তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি চুকাতে হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হিন্দুদের প্রতি রাষ্ট্রের ব্যবহার ছিল বৈষম্যমূলক।
মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত থেকে ফিরে যাওয়া হিন্দু শরণার্থীরা অনেকেই তাদের ফেলে যাওয়া বিষয়-সম্পত্তি ফিরে পাননি। বেদখল হয়ে গেছে। জবরদখলকারীদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতা বা তাদের সমর্থক। দুর্বল সংখ্যালঘুরা প্রাণের ভয়েই অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাননি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা প্রশাসন থেকে সুবিচার পায়নি নির্যাতিত হিন্দুরা।
তিনি আরো লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিমূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তিনি যখন দেশের সর্বেসর্বা, প্রধানমন্ত্রী- তখন সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তাদের আর্জি ছিল ঢাকা দক্ষিণস্থ মহাপ্রভুর মন্দিরের জবরদখলকৃত জমিজমা ফিরিয়ে দেওয়া।
বঙ্গবন্ধু সব শুনে প্রতিনিধি দলকে মুখে উপর জবাব দেন, তা সম্ভাব হবে না। কারণ, জবরদখলকৃত জমি উদ্ধার করতে গেলে রাজনৈতিক দিক দিয়ে যেমন অসুবিধা আছে, তেমনি উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দেওয়াও সরকারের পাক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। এই ছিল একজন রাষ্ট্রনায়কের স্বাীকারোক্তি। প্রতিনিধি দলে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে আগে থেকে জানতেন।
যুক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির অন্যতম বিশ্বস্ত অনুচর হিসেবে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর সময় তার ভূমিকা এবং পরবতীতে সিলেট রেফারেন্ডমে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের সর্দার হিসেবে সংখ্যালঘু-বিরোধী বীরত্বব্যঞ্জক দায়িত্ব পালনের কথা। ঢাকা দক্ষিণের প্রতিকুল সেদিন সংস্কৃত আপ্তবাক্য ‘অঙ্গরশতধৌতেন মলিনাঞ্চন মুচ্যতে’-র প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব সাড়ে তিন বছরে ক্ষমতায় ছিলেন এবং তিনি ছিলেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। বিরোধী দলসমূহের গুরুত্ব অস্বীকার করে একদলীয় ‘বাকশাল’ শাসন প্রবর্তিতে হয়েছিল। কিন্তু হিন্দু বাঙ্গালীদের দুর্দশার যে মারণযন্ত্র আয়ুব খান প্রচলিত ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ তা বাতিল করার কোনও প্রয়াসই নেওয়া হয়নি।
‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ নাম পরিবর্তিত করে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নতুন নামকরণ করা হয়েছে, কিন্তু বিষয়বন্তু তো একই রয়ে গেছে। এই শত্রু সম্পত্তি আইনের সুযোগ নিয়েই হিন্দুদের বিষয় সম্পত্তি সেমন আত্মসাৎ করা হচ্ছে, তেমনি ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে দেশান্তরী হতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই জবরদখলকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীদের নেতা-কর্মীরা প্রথম থেকেই এগিয়ে ছিলেন, এখন দল ক্ষমতায় থাকার তাদেরই একচ্ছত্র অধিকার। এই জবরদখলকারীদের মধ্যে প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, সাংসদ এবং আঞ্চলিক নেতারাও রয়েছেন। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দুষ্কৃতীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা হয় আওয়ামী লীগ নেতা বা কর্মী, নয়তো দল আশ্রিত সমাজ-বিরোধী। সম্প্রতি পটুয়াখালিতে মা ও মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় যাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সে আওয়ামী লীগের এক আঞ্চলিক নেতা।
অতীন তার কলামে লিখেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, খালেদা জিয়ার আমলে ব্যাপক হারে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে যে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল, তার প্রতিবেদন পাওয়া সত্ত্বেও এত বছরের মধ্যে কেন প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবন্থা নেওয়া হল না।
সরকারের এই আচরণে নির্যাাতিতদের মধ্যে যেমন হতাশায় সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি দুষ্কৃতীরা বেপরোয়া হয়েই তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে উৎসাহ পাচ্ছে। শেখ হাসিনা যদি প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংখ্যালঘু-দরদী হয়ে থাকেন, তা হলে সংসদে তার নিরষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও কেন ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ -এর বিলুপ্তি ঘটছে না? যারা জবরদস্তি করে হিন্দুদের জমি-বাড়ি থেকে উৎখাত করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনের শাসন এত শ্লথ কেন? শেখ মুজিবের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের সঙ্গে সম্পাদিত শাস্তি চুক্তি এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। শেখ হাসিনা আমলাতন্ত্রের দোহাই দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব স্খলন করতে চাইছেন।
তিনি লিখেছেন, আসলে বাংলাদেশে যারাই ক্ষমতায় বসবে তাদেরই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করে চলতে হয়। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ‘বাংলাদেশ উলামা লীগ’ প্রকাশ্যে মিছিল করে দাবি জানিয়েছে ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চলবে না, পূজা ইত্যাদি অনৈসলামিক কাজে রাষ্ট্র কর্তৃক কোনও পৃষ্ঠপোষকতা করা চলবে না, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অমুসলিম সুরেন্দ্রকুমার সিংহকে অপসারণ করতে হবে। বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য সমিতিকে নিষিদ্ধ করতে হবে ইত্যাদি। আওয়ামী লীগে এখন আর সংখ্যালঘুদের স্বার্থে কথা বলার মতো হিন্দু নেতা নেই।
কোনও আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হলে প্রকাশ্য সভায় এমন মন্তব্য শোনা যায়, ‘মালাউনরা ভোট দেয়নি তাই নৌকা ডুবেছে’।
তসলিমা নাসরিন সঠিকই বলেছেন, ‘এখন আর লজ্জা নয়, ভয় হয়।’ বাংলাদেশে যা ঘটছে, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই দেশটি হিন্দুশূন্য হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা এখন ইসলামিক ঐক্যজোটের দেশগুলোর প্রতি খুব ঝুঁকেছেন। সম্প্রতি সৌদি আরব সফরে গিয়ে ‘উমরাহ’ সেরেছেন এবং আরবের বাদশাহর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিত চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ লক্ষ বাংলাদেশিকে ওই দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মক্কা এবং মদিনায় আল্লার ঘর রক্ষার জন্যে বাংলাদেশি সৈন্যদের পাঠাবারও প্রস্তাব রেখেছেন। সৌদি আরব বিশ্বব্যাপী ওয়াহাবি ইসলাম প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ তার ঘাটি হয়ে উঠলে সে দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়াবে।(আমাদের সময়)