কোথায় প্রথম তৈরি হয় রসগোল্লা? পশ্চিমবঙ্গ, না ওডিশায়? এ নিয়ে বেধেছিল গোল। স্বত্ব নিয়ে টানাটানি। আড়াই বছর পর মিলল সমাধান।
এল সিদ্ধান্ত। রসগোল্লার এখন কলকাতার। গতকাল মঙ্গলবার সরকারের এই সিদ্ধান্তের খবর কলকাতায় পৌঁছাতেই খুশির হাওয়া বইতে শুরু করে রাজ্যজুড়ে।
প্রচলিত ছিল, কলকাতার এক মিষ্টি ব্যবসায়ী প্রথম তৈরি করেন রসগোল্লা। সেভাবেই এর স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। ২০১৫ সালের জুনে ওডিশা থেকে রব ওঠে, রসগোল্লা প্রথম তৈরি হয় তাদেরই রাজ্যে।
সেই থেকে শুরু দুই রাজ্যের দ্বন্দ্ব। তবে শেষ হাসি হাসল পশ্চিমবঙ্গ। ভারত সরকার থেকে স্বীকৃতি পেল রসগোল্লা কলকাতারই সৃষ্টি। ভারতের রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড প্রোটেকশন আইনের আওতায় জিআই বা জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন ফর গুডস’ পেটেন্ট পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
দাবি ওঠে প্রতিবছর ১৪ নভেম্বরকে রসগোল্লা দিবস পালনের। লন্ডন সফররত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই খবরের পর এক টুইটার বার্তায় বলেন, ‘সবার জন্য মিষ্টি খবর। বাংলার রসগোল্লা জিআই পাওয়ায় আমি খুশি ও গর্বিত।’
রসগোল্লার আবিষ্কারক কলকাতার সাবেক চিনি ব্যবসায়ী নবীন চন্দ্র দাস। তিনি ১৪৯ বছর আগে রসে ভেজানো গোলাকার এই রসগোল্লা তৈরি করেন। তবে ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট ওডিশার রাজ্য বিধানসভায় দাবি ওঠে, রসগোল্লা ওডিশার।
এর মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশার মধ্যে রসগোল্লা নিয়ে গোল বেধে যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও জানিয়ে দেয়, রসগোল্লা বাংলার, বাঙালিদের রসনাতৃপ্তির সেরা মিষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য। সে সময় ইতিহাসবিদ হরিপদ ভৌমিকও বলেন, রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। রসগোল্লা বাংলার, বাঙালির সম্পদ।
নবীন চন্দ্র দাসের পঞ্চম প্রজন্ম, উত্তরসূরি ধীমান দাস একবার এক সাক্ষাৎকারে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। নবীন চন্দ্র দাস যে রসগোল্লার আবিষ্কারক, তা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে তিনি অতীতের কিছু তথ্যও তুলে ধরেন।
ধীমান দাসের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৬৪ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে একটি মিষ্টির দোকান খোলেন কলকাতার চিনি ব্যবসায়ী নবীন চন্দ্র দাস। বেশি দিন ওই মিষ্টির দোকানটি চলেনি। ফের ১৮৬৬ সালে কলকাতার বাগবাজারে আরেকটি মিষ্টির দোকান খোলেন তিনি।
এই দোকানটির প্রধান মিষ্টি ছিল সন্দেশ। তবে কলকাতা শহরের খানদানি বণিকদের যেন সন্দেশে আশ মিটছিল না। তাই নবীন চন্দ্র দাস নতুন মিষ্টি তৈরির কথা ভাবছিলেন। পরে দুই বছরের মধ্যে তিনি তিনি তৈরি করেন রসগোল্লা।
ধীমান দাস একটি ঘটনার কথাও বর্ণনা করেন। একদিন বাগবাজারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় ঘোড়ায় টানা একটি জুড়ি গাড়ি। গাড়িতে ছিলেন কলকাতার এক ধনাঢ্য ব্যক্তি ভগবান দাস বাগলার।
গাড়িতে বসে ভগবান দাসের ছেলের পানি খেতে চাইলে ওই মিষ্টির দোকানের সামনে আসেন তাঁরা। ছেলেকে এক গ্লাস জল ও একটি রসগোল্লা দিতে বলেন ভগবান দাস। রসগোল্লা খেয়ে ওই ছেলে এতই মজা পান যে এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি ফেরেন ভগবান দাস।
এর কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার ছড়িয়ে পড়ে রসগোল্লার সুখ্যাতি। এরপর পশ্চিমবঙ্গ। একসময় বাংলাদেশেও।
রসগোল্লার স্বত্ব নিয়ে ওডিশার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট ওডিশার বিধানসভায় বিজেপির বিধায়ক আর পি সোয়াইন দাবি তোলেন, ওডিশার রসগোল্লার ঐতিহ্যকে ছিনিয়ে নিতে চায় বাংলা।
তিনি বলেন, ‘পুরীর জগন্নাথদেবকে এই রসগোল্লা নিবেদন করা হয়। ৩০০ বছরের পুরোনো এই প্রথা, অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার দাবি করেছে, রসগোল্লা নাকি বাংলার আবিষ্কার। এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না।’ এই দাবির প্রতি সেদিন আরও সমর্থন জানান বিজেপির আরেক বিধায়ক প্রিয়দর্শী মিশ্র। তিনি বলেন, প্রতিবছর উল্টোরথের আগের দিন গোটা ওডিশায় পালিত হয় ‘রসগোল্লা দিবস’।
তবে ওই সময় ইতিহাসবিদ হরিপদ ভৌমিক বলেন, পুরীর মন্দিরে ভোগ দেওয়া দেওয়া হতো ক্ষীরমোহন দিয়ে। ক্ষীরমোহন ছানা দিয়ে তৈরি হতো না। দুধ জ্বালিয়ে তৈরি ক্ষীর থেকে তৈরি হতো ক্ষীরমোহন।
তা ছাড়া এখনো ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে রসগোল্লা দিয়ে ভোগ দেওয়া হয় না। ভোগ দেওয়া হয় ক্ষীরের তৈরি মিষ্টি দিয়ে। কারণ, ক্ষীর তৈরি হয় আসল দুধ জ্বালিয়ে আর রসগোল্লার ছানা তৈরি হয় দুধ নষ্ট করে বা অম্ল যোগ করে।
সেই জন্য এই ছানা কোনো পূজা-পার্বণে দেবতার ভোগে দেওয়া হতো না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছিলেন, রসগোল্লা বাংলারই। রসগোল্লার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার লড়াই করবে।
অবশেষে সব দ্বন্দ্ব শেষে রসগোল্লার স্বত্বাধিকার পেল পশ্চিমবঙ্গই। রসগোল্লা নিয়ে যে গোল বেধেছিল, তার সমাপ্তি হলো।
নিউজ ডেস্ক:
আপডেট, বাংলাদেশ ৩:১৫ পিএম, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭ বুধবার
এ.এস