চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৩:১৪ অপরাহ্ন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫, সোমবার
দেশের চিকিৎসাসেবার সর্বোচ্চ পীঠস্থান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ফেরি করে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, দেশের খ্যাতনামাসহ একাধিক ওষুধ কোম্পানির মাকের্টিং রিপ্রেজেনটেটিভরা চিকিৎসকও নার্সদের ম্যানেজ করে এবং রোগীদের অপেক্ষাকৃত কম দামে ওষুধ দেয়ার নামে অনৈতিকভাবে সরাসরি ওষুধ বিক্রিতে নেমেছেন।
এদের কেউ কেউ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে যখন-তখন প্রবেশ করে রোগীর বেডে গিয়ে ওষুধ বিক্রি করছেন। আবার কেউবা রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছে মোবাইল নম্বর দিয়ে আসছেন। সেইসঙ্গে ওষুধ কোথা থেকে সরবরাহ করা হবে সেই ঠিকানাও লিখে দিয়ে আসছেন। হাসপাতালের আশেপাশের বটতলা চায়ের দোকান, শহীদ মিনার ও দোয়েল চত্বরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। অনুসন্ধান ও বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন জটিল রোগের (তীব্র নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিও পালমোনারি, জটিল মূত্রনালীর সংক্রমণ, কিডনি সমস্যা, প্রসব প্রসব পরবর্তী ও ব্যাকটেরিয়াল ম্যানেনজাইটিস) সংক্রমণরোধক মেরোপেনাম গ্রুপের ওষুধ ও ইনজেকশনের বেশি বিক্রি হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ওষুধটি এমআরপি (মার্কেটিং রিটেইল প্রাইজ) বাজার মূল্যে ১২শ’ টাকা। ওষুধের অতিরিক্ত দাম ও প্রয়োজনীয় আর্থিক তহবিল স্বল্পতার কারণে অধিকাংশ সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এটি বিনামূল্যে রোগীদের সরবরাহ করতে পারে না। এ সুযোগে ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এটি লিখিয়ে নিয়ে একচেটিয়া বাণিজ্য চালাচ্ছে। এছাড়াও ক্যান্সারের চিকিৎসায় বিভিন্ন ওষুধও একই কায়দায় ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৬ জুলাই ঢাকা মেডিকেল মেডিসিন মার্কেট মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. লুৎফর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সরদার রবিউল হাসান তাদের সদস্যদের দেয়া এক চিঠিতে বলেন, ‘রেনেটা কোম্পানির প্রতিনিধিরা প্রতিনিয়ত ঢামেক হাসপাতালের অভ্যন্তরে রোগীর নিকট সরাসরি অবৈধ পন্থায় ফেরি করে ওষুধ বিক্রি করে আসছে। এতে ব্যবসার আর্থিক অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
তারা সমিতির মাধ্যমে বিভিন্ন সময় মৌখিক ও লিখিতভাবে কোম্পানিকে বিষয়টি অবহিত করা স্বত্ত্বেও তাতে কোম্পানি কর্ণপাত বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তাই ২৫ জুলাই বাধ্য হয়ে সমিতির সিদ্ধান্ত মোতাবেক রেনেটা কোম্পানির সঙ্গে কোনো প্রকার লেনদেন ও ওষুধের অর্ডার স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। লিখিতভাবে বলা হয়, সমিতির পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত রেনেটার সঙ্গে কোনো প্রকার লেনদেন ও অর্ডার নেয়া ওষুধ সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকতে ফার্মেসি মালিকদের অনুরোধ করা হলো।
২ আগস্ট তাদেরই আরেক চিঠিতে বলা হয়, অবৈধ পন্থায় ওষুধ বিক্রয়ের কারণে রেনেটা লিমিটেডের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদন ও অর্ডার বন্ধ রাখা হলেও মেডিকেলের ভিতর কিছু কিছু কোম্পানির প্রতিনিধিরা ওষুধ বিক্রয় বন্ধ করিনি। তারা ৪ আগস্ট এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠক ডাকেন।
এর আগে ২৮ জুলাই রেনেটার সিনিয়র ডেপুটি সেলস ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান সমিতির কাছে দেয়া এক চিঠিতে বলেন, ঢামেক হাসপাতালের সামনের দোকানদার ভাইদের সঙ্গে সামান্য ভুল বুঝাবুঝির কারণে তাদের কার্যক্রম স্থগিত আছে। তাই ভুল বোঝাবোঝির অবসানকল্পে সমিতির নেতাদের সঙ্গে বসতে চান।
ঢাকা মেডিকেল মেডিসিন মার্কেট মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. লুৎফর রহমান সঙ্গে আলাপকালে বলেন, গত ৪০ বছর ওষুধের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছি। অতীতে কখনো ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ফেরি করে ওষুধ বিক্রি করতে দেখিনি।
তিনি বলেন, কেমিস্টদেরই ওষুধ বিক্রি করার কথা। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে দেবে। হাসপাতালে সরবরাহ থাকলে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে অন্যথায় রোগী প্রেসক্রিপশন নিয়ে ফার্মেসিতে এসে ওষুধ কিনবে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টার্গেট পুরণে ফেরি করে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। সকালে হাসপাতালে ও বিকেলে বটতলা চায়ের দোকান, শহীদ মিনার কিংবা দোয়েল চত্বর থেকে ওষুধ বিক্রি চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বেঁধে দিলেও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তা মানছেন না। চাকরি রক্ষার্থে কোম্পানির বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট টাকার ওষুধ বিক্রির টার্গেট পূূরণে মার্কেটিং প্রমোশনের নামে ওষুুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা সময়-অসময়ে হাসপাতালে প্রবেশ করে স্ব স্ব কোম্পানির ওষুধ লিখতে চিকিৎসকদের নানাভাবে প্রলোভিত করছেন।
বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে চিকিৎসকদের পদ পদবিভেদে নগদ টাকার মাসিক চুক্তি, ল্যাপটপ, দামি মোবাইল ফোন সেট, বিদেশ ভ্রমণের ফ্রি টিকিট, সেমিনার সিম্পোজিয়ামের স্পন্সরশিপসহ বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রীর লেনদেনের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। চিকিৎসকদের সঙ্গে এখন নার্সদেরও গোপন চুক্তি হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে ডাক্তার ভিজিটের সময় মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের আটকও করা হয়েছে। মুচলেকা দিয়ে তারা ছাড়া পেয়েছেন।
গত ১০ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে ওষুধ শিল্প সমিতির নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তিনি সর্বশেষ ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক থাকাকালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের জন্য সপ্তাহে দুদিন-সোমবার ও বুধবার ডাক্তারদের ভিজিট করার সময় বেঁধে দেন। কিন্তু কেউ সে নির্দেশনা মানেননি। প্রায় প্রতিদিন সময়-অসময়ে তারা ডাক্তারদের কক্ষে প্রবেশ করতেন এমনকি ডাক্তারের পাশে বসে রোগীর জন্য ওষুধ প্রেসক্রাইব করাতেন বলে তিনি মন্ত্রীকে অবহিত করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ওষুধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মুনিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, মার্কেট প্রমোশনের নামে ওষুধ কোম্পানিগুলো আগ্রাসি বাণিজ্যে নেমেছে। তারা চিকিৎসকদের টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে। চিকিৎসকরা নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে কোম্পানির ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিদের ইচ্ছানুসারে ওষুধপত্র লিখছেন। ফলে জনস্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে পড়ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫