কালের বির্বতনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কাচারি ঘর। এই কাচারি ঘর ছিলো গ্রামের অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ পরিবার ও বাড়িগুলোর আভিজাত্যের প্রতীক। বাড়ির বাহির আঙিনায় অতিথি, মুসাফির, বাড়ির যুবক, ছেলে, ছাত্র ও জায়গিরদের থাকার এ ঘরটি কাচারি ঘর বা বাংলা ঘর নামে সমধিক পরিচিত ছিলো। কালের বিবর্তনে মতলব উত্তরে গ্রামাঞ্চলের সেই কাচারিঘর মুষ্টিমেয় কিছু বাড়িতে এখনও টিকে থাকলেও নেই তার জৌলুস বা ব্যবহার। অধিকাংশ পরিবারই একক বা যৌথ কাচারি ঘর তৈরির প্রথা বাদ দিয়ে এখন ছোট পরিসরের ড্রয়িংরুমের দিকে ঝুঁকেছেন। বর্তমানকালে ড্রয়িংরুমের সাজ-সজ্জার মাধ্যমে কোনো অভিজাত পরিবারের আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
ঝাড়বাতি, সোফাসেট, অ্যাকিউরিয়াম, ইন্টেরিয়র, রুচি অনুযায়ি কোনো ছবি দিয়ে মনোমুগ্ধকর ভাবে সাজানো হয় ড্রইংরুম বা অতিথিশালা। উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার আদুরভিটি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ নুরু ঢালী (৭৫) আলাপকালে জানান, এক সময়ে একক বা যৌথ গৃহস্থ বাড়ির আভিজাত্যের প্রতীকই ছিল বাড়ির বাহির আঙিনার বৈঠকখানা; মানুষের কাছে যা কাচারি ঘর নামে পরিচিত ছিল। এ কাচারি ঘরের চৌকির ওপর থাকত বাড়ির অবিবাহিত ছেলে বা ছাত্ররা। আর মেহমান বা অতিথিরা এলে চৌকির ওপরে থাকতে দেয়া হতো। মাটিতে একঢালা হোগল পাতার বা বাঁশের চাটাই বিছিয়ে বিছানা করে থাকত বারোমাসি কামলারা (শ্রমিক) ও রাখাল । গড়গড় শব্দে তারা হুক্কা টানত আর ধোঁয়া ছাড়ত। প্রতি রাতেই পাড়ার সব কামলা/রাখাল বড় কোনো কাচারি ঘরে মিলিত হয়ে গানের আসর বসাতো। চলতো পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, রূপবান,গুনাই বিবি, আলোমতি, সাগরভাসা, বেহুলা লখিন্দরের পালা। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত বসত শালিস বৈঠক। গৃহ অভ্যন্তরে যারা থাকতেন তাদের চোখেও ঘুম ছিলো না, চা আর পানেরফরমায়েশ রক্ষা করতে।
প্রায় প্রতিটি রাতে কাচারি ঘরওয়ালা বাড়িতে আসত অনাত্মীয়- অচেনা কোনো মুসাফির। ভেতর বাড়ি থেকে শোনা যেত কোনো অচেনা মুসাফিরদের কণ্ঠ, “ বাড়িতে কেউ আছেন? থাকবার জায়গা হইবে। অনেক রাত হইছে, নদী পার হওন যাইবো না।”নদীমাতৃক বাংলাদেশে এ নদীর কারণেই বাঙালিরা হয়তো অতিথি পরায়ণ হয়ে উঠেছিল। যেমন আরবের মানুষ অতিথি পরায়ণ হয়েছিল শুধু মরুভূমির জন্যে। যত রাতেই আসুক, অতিথিদের না খেয়ে শুতে দিত না বাড়িওয়ালারা। আবার এ সব অতিথিরা ভোর রাতের অন্ধকার থাকতেই উঠে চলে যেত, এদের কারণে বাড়ির কোনো কিছু খোয়া যায়নি কোনো দিন।
উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার ঝিনাইয়া গ্রামের সাবেক মেম্বর তাইজুল ইসলাম খান (৭৩) বলেন, কাচারি ঘরের সামনের অংশে থাকতো বারান্দা। বারান্দায় সব সময় একটি হেলনা বেন্চ থাকতো।
ক্লান্ত পথিকরা এখানে বসে একটু জিড়িয়ে নিত। কখনো কখনো পান-তামাক (হুক্কা) খেয়ে ক্লান্তির অবসাদ দূর করতো। বারান্দার একপ্রান্তে ছোট কক্ষে থাকতেন বাড়ি লাগোয়া মসজিদের মৌলভী বা মক্তবের শিক্ষক। এখন অধিকাংশ বাড়িতে কাছারি ঘর নেই। যে কয়টি আছে তা ব্যবহৃত না হওয়ায় অবহেলা, অযত্নে ধ্বংস প্রায়। গ্রামে আর বারোমাসি রাখালের প্রচলন নেই, নেই রাখালি গান। বাড়ির ছেলেদেরও রাতে ঘরের বাইরে থাকার অনুমতি নেই। অবকাঠামো ও যোগাযোগের উন্নতির ফলে মাঠে ঘাটে যারা কাজ করে তারা দিন শেষে নিজ বাড়িতে চলে যায়। পরিবার গুলো ছোট ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদক: কামাল হোসেন খান, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩