ইসলামে নামাজের পরই জাকাতের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে নামাজের পাশাপাশি জাকাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে। জাকাত ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ,যা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্য রক্ষা করে সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। এটি নিছক একটি দান নয় বরং একজন মুসলিমের জন্য ফরজ ইবাদত।
প্রত্যেক স্বাধীন,পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ,যদি তা ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে তবে,গরিব-দুস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে জাকাত বলা হয়। কুরআন ও হাদিসে জাকাতের গুরুত্ব বারবার তুলে ধরা হয়েছে এবং মুসলিম অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের একটি কার্যকর হাতিয়ার।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন,‘এবং তাদের ধন সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক।’ (সূরা আয-জারিয়াত : ১৯) এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। জাকাত এমন একটি ব্যবস্থা,যা ধনীদের থেকে সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করে,ফলে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি হয়।
নবি (সা.) মু’আয (রা.)-কে ইয়ামান দেশে (শাসক হিসাবে) পাঠান। অতঃপর বললেন,সেখানকার অধিবাসীদের এ সাক্ষ্যদানের প্রতি আহ্বান করবে যে,আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তা মেনে নেয়, তবে তাদের অবগত কর যে,আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর প্রতিদিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। যদি সেটাও তারা মেনে নেয়,তবে তাদের অবগত কর যে,আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর সম্পদের মধ্য থেকে সদকা (জাকাত) ফরজ করেছেন। যেটা ধনীদের কাছ থেকে গৃহীত হবে আর দরিদ্রদের মধ্যে দেয়া হবে।
আধুনিক প্রকাশনী: ১৩০৫,ইসলামিক ফাউন্ডেশন : ১৩১০) এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়,জাকাতের কারণে দারিদ্র্য কমে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়। মুসলিম অর্থনীতিবিদ ইবনে খালদুন তার‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,জাকাত একটি কার্যকর সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থা,যা অর্থনীতিতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি (রা.)-এর ভাষায়-জাকাত শরিয়তের এমন এক অকাট্য বিধান,যে সম্পর্কে দলিল-প্রমাণের আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। জাকাত সংক্রান্ত কিছু কিছু মাসালায় ইমামদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকলেও মূল বিষয়ে অর্থাৎ জাকাত ফরজ হওয়া সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। জাকাতের ফরজিয়তকে যে অস্বীকার করে,সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।’-ফাতহুল বারী ৩/৩০৯
আধুনিক অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন,জাকাতের সঠিক বাস্তবায়ন হলে সমাজে বেকারত্ব কমে এবং নিুআয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত হয়। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ ধনীদের আরও ধনী করে এবং গরিবদের আরও বঞ্চিত করে। কিন্তু ইসলামিক অর্থনীতিতে জাকাত ধনীদের থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে,অর্থনীতির একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করে। জাকাত প্রদানে ইসলামের কঠোরতা রয়েছে। যেমন-হজরত আবু বকর (রা.) বলেন-আল্লাহর শপথ! তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আমি যুদ্ধ করব,যারা সালাত ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে,কেননা জাকাত হলো সম্পদের ওপর আরোপিত হক। আল্লাহর কসম। যদি তারা একটি মেষশাবক জাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায়,যা রাসূল (সা.)-এর কাছে তারা দিত,তাহলে জাকাত না দেয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব।
‘ওমার (রা.) বলেন-আল্লাহর কসম,আল্লাহ আবুবকর (রা.)-এর হৃদয় বিশেষ জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেছেন বিধায় তার এ দৃঢ়তা,এতে আমি বুঝতে পারলাম তার সিদ্ধান্তই যথার্থ। (মুসলিম ১/৮,হা:২০,আহমাদ ২৪,১০৮) জাকাত শুধু দারিদ্র্যবিমোচনের হাতিয়ার নয় বরং এটি সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে শক্তিশালী করে। তাই বলা যায়,জাকাত একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা,যা দারিদ্র্য,বঞ্চনা ও বৈষম্য দূর করে একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। জাকাতের সঠিক প্রয়োগই পারে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে আলোকিত একটি ভবিষ্যৎ গড়তে।
চাঁদপুর টাইমস
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
এজি