চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের কর্মকর্তারা যেন চলছে তাদের ইচ্ছাধীন নিয়মে। সরকারি নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা না করে গত এক বছর ধরে চলছে নতুন যোগদানকৃত উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন মিয়ার নিয়মে। ইতিপূর্বে স্থানীয় ও জাতীয় পত্র পত্রিকায় উপজেলার এ প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হলেও যেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোন টনক নড়ছেনা।
সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে জানাযায়, হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের ভেটেরিনারি হাসপাতালের দায়িত্বরত ভিএফএ আলী আজগর গবাদি পশু পাখির সরকারী ভ্যাকসিন ও ঔষধ গোপনে বিক্রি করে আসছেন। উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন মিয়ার যোগসাজশে ভিএফএ আলী আজগর তার বাসায় পর্যন্ত সরকারী ঔষুধ মওজুদ করে রেখেছে।
রবিবার সকালে উপজেলার ভিতরে ভিএফএ আলী আজগরের বাসায় প্রবেশ করে দেখা যায় তার খাটের নিচে সরকারি ভ্যাকসিন ও ওষুধের একাধিক কাটুন। এগুলো বিভিন্ন খামারে গোপনে বিক্রি করে আসছেন এ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব ক্রেতাদের তথ্যমতে ভিএফএ আলী আজগরকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বিষয়টি স্বীকার করে সাংবাদিকদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। হাতেনাতে ধরাশায়ী এ কর্মকর্তা এক প্রকার মাথায় হাত দিয়ে বসে হতভম্ব হয়ে পড়েন।
ভিএফএ আলী আজগরের বিষয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বরং তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ প্রকাশ করেন। উভয় কর্মকর্তার গতিবিধি ও আচরন পর্যালোচনা ও খামারিদের অভিযোগের ভিত্তিতে অনিয়মের বিষয়টি প্রমানিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের দেওয়া গবাদিপশু পাখির ভ্যাকসিন ও ঔষুধ গোপনে বিভিন্ন খামারিদের কাছে বিক্রি করে আসছেন এ দুই অসাধু কর্মকর্তা।
এছাড়াও সরকারি বেতন ভূক্ত প্রাণি সম্পদ এসব কর্মকর্তার চিকিৎসাপত্রে নাম সর্বস্ব কোম্পানির ঔষধ এবং ভিটামিন পণ্য লেখার অভিযোগ উঠেছে। যেখানে অনুমোদনহীন নাম সর্বস্ব ঔষধ ও পণ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেখানেই অনুমোদনহীন ঔষধ নিজের চিকিৎসাপত্রে লিখে যাচ্ছেন উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন মিয়া।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, গত ২ মাস ধরে হাজীগঞ্জ বাজারের একাধিক দোকানে বায়ো-প্রোডাক্ট ম্যানুফ্যাচারিং ইউনিট (বিএমইউ) এর ওয়াইফেন রিচার্জ ল্যাবটরিজ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি পশু ও পাখির ভিটামিন জাতীয় ঔষধ বাজার জাত করে আসছে। যা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন মিয়ার চিকিৎসাপত্র ছাড়া জেলার অন্য কোন কর্মকর্তা লিখেন না।
বাজারে পাওয়া পণ্য গুলো হচ্ছে গরু ও ছাগলের জন্য কাউ প্রি—মিক্স যার ইংরেজি নাম Powder- COW PRE-MIX এবং হাঁস-মুরগীর চিকিৎসায় পোলট্রি প্রি-মিক্স যার ইংরেজি নাম Powder- POULTRY PRE-MIX নামে দুটি ফুড অ্যাডিটিভ, এনজাইম এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ প্রোবায়োটিক পণ্য এবং গরুর ক্ষত রোগের চিকিৎসায় লাম্পি কিউর যার ইংরেজি নাম Lumpy Cure নামে একটি পণ্যসহ মোট তিনটি পণ্য। পণ্যের প্যাকেজিংয়ে উল্লেখিত উৎপাদন ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াইফেন রিচার্জ ল্যাবটরিজ এর মিক্স-পণ্য ও ঔষধ বাজারজাত করণের নেই কোন অনুমোদন।
মোড়কে থাকা ঠিকানায় দেখা যায়, গাজীপুর সদরের মির্জাপুর বিকে বাড়ি। যার ডিএলএস লাইন্সেস নাম্বার— ৫১৭। কিন্তু সরেজমিনে এর কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইডে প্রকাশিত তালিকায় পশু খাদ্য আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ (ক্যাটগরি—২) প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ৫১৭ (একই) লাইসেন্সে সেইফ ইউনিয়ন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়। যার স্বত্ত্বাধিকারী তারিকুল ইসলাম। গাজীপুর সদরের চান্দনা চৌরাস্তায় ৫৬ এম কে স্যাটালাইট টাউনে তাদের সংরক্ষনাগারও রয়েছে।
এ প্রতিষ্ঠানটির লাইন্সেস নাম্বার ব্যবহার করে গাজীপুর জেলার টঙ্গী ইন্ড্রাস্ট্রিজ এরিয়ার বায়োপ্রোডাক্ট ম্যানুফেকচারিং ইউনিট (বিএমইউ) এবং ওয়াইফেন রিচার্জ ল্যাবটরিজ এর ঠিকানা বদল করে গাজীপুর সদরের মির্জাপুরে একটি ঠিকানা দেখিয়ে কাউ-প্রি-মিক্স, পোলট্রি প্রি-মিক্স এবং গরুর ক্ষত রোগের জন্য লাম্পি-কিউর নামে তিনটি পণ্য উৎপাদন করে তা বাজারে বিক্রয় করে আসছে। যা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য।
আর এ পণ্য চিকিৎসাপত্রে লিখে সরাসরি বাজারে সাপ্লাই দিয়ে আসছেন খোদ উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন মিয়া।
এ বিষয়টি নিশ্চিত করে মোবাইল ফোনে প্রতিবেদককে জানান কোম্পানিটির প্রস্তুতকারক জাহাঙ্গীর। এ সময় তিনি বলেন, করোনার কারণে এ তিনটি পণ্যেও অনুমোদন পাননি। তবে অনুমোদন না নিয়ে বাজারে রিচার্জের জন্য পণ্যগুলো সাপ্লাই করে আসছেন। উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন মিয়াকে তিনি এ প্রি-মিক্স পণ্যগুলো চিকিৎসাপত্রে লেখার জন্য বিক্রিত কমিশনের শর্তে ম্যানেজ করেন।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিজেই পণ্যগুলো হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজারের আল মদিনা পোলট্রি, আখড়া মার্কেটে ওয়াসিমের বন্ধু ডেইরি এন্ড পোলট্রি ফিড এবং পূর্ব বাজারে আব্দুর ছাত্তারের পপুলার পোলট্রি ফিড দোকানে বিক্রয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন।
ওয়াইফেন কোম্পানির নিজস্ব কোন সেলস ম্যান নেই। উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তার অধিন্যস্ত বড়কুল পূর্ব ইউনিয়নে ভ্যাক্সিনেটর হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মোহাম্মদ উল্ল্যাহ বুলবুল ওই কাজ করছেন।
সরকারি চাকরির বিধান অনুযায়ী স্ব-স্ব দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা ওই প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কোন ব্যবসার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত পারবেন না। অথচ প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা হয়েও ডা. মোহাম্মদ শাহীন মিয়া নিজেই নাম সর্বস্ব অনুমোদনহীন ওই কোম্পানির ঔষধ বিক্রয় করে আঙ্গুল ফুঁলে কলাগাছ বনে গেছেন।
কাউ প্রি-মিক্স ও পোলট্রি প্রি-মিক্স এর মূল্য ৪১০ টাকা। এ চড়াও মূল্যে ভিটামিন এনজাইম পণ্যগুলো চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় শতকরা ৯৮জন খামারির গরু, ছাগল ও মুরগির চিকিৎসাপত্রে লিখছেন। যা নিয়মের পরিপন্থি। বাধ্য হয়ে খামারিরা মেনে নিচ্ছেন, আর হচ্ছেন প্রতারিত।
এ ছাড়াও দায়িত্ব পালনে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। হাজীগঞ্জের ইউনিয়নে সেবাকর্মী ও বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এআই কর্মী এবং পোলট্রি ব্যবসায়ীদেও কারণ ছাড়াই হুমকি ধমকি দিয়ে এ পণ্য গুলো বিক্রয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করার অভিযোগ উঠেছে।
অনুমোদনহীন তিনটি পণ্যের নমুনা নিয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার মো. বখতিয়ার উদ্দিন বলেন, অনুমোদনহীন কোন পণ্য ও ঔষধ বাজারে আসলে ওই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। যদি তার চিকিৎসাপত্রে লিখে থাকেন। এটি ঠিক নয়। ওই কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে দেখেন ওনি কি বলতে চায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলামের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে বিষয়টি আরেকটি অফিসের নিজস্ব ব্যাপার যে কারণে আমি তদারকি করতে চাইনা। তার পরেও প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে বিষয়টি জানার চেষ্টা করবো।
প্রতিবেদক: জহিরুল ইসলাম জয়, ১৮ জুন ২০২৩