চাঁদপুর জেলার অন্যতম ব্যস্তময় বানিজ্যিক শহর হাজীগঞ্জ। যেখান দিয়ে চাঁদপুর কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়কসহ চট্টগ্রাম -ঢাকা বাইপাস সড়কপথ হিসাবে দৈনিক ছোট বড় হাজার হাজার যানবাহন চলাচল।
হাজীগঞ্জ বাজারের উপর দিয়ে এসব সড়কের যাওয়া আসা যানবাহনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিএনজি। বাজারের পশ্চিম থেকে পূর্ব মাথা ও আশপাশের কচুয়া ও রামগঞ্জ সড়কের মুখ পর্যন্ত রয়েছে প্রায় ২০ টি অবৈধ সিএনজি স্ট্যান্ড। যেখান থেকে মাসে চাঁদাবাজি হচ্ছে প্রায় অর্ধকোটি টাকা। আর এসব স্ট্যান্ড বসিয়ে দৈনিক প্রায় লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করছে স্থানীয় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও তাদের অনুসারীরা।
শুধু মাত্র হাজীগঞ্জ বাজার নয়, এমন পুরো উপজেলাতেই সড়কের উপর রয়েছে অর্ধশত অবৈধ সিএনজি স্ট্যান্ড। যা থেকে দৈনিক প্রায় কয়েক লক্ষ টাকা অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করে নিচ্ছে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীরা সিন্ডিকেট। যাদের অধিকাংশই স্থানীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে সড়কের উপর স্ট্যান্ড বসিয়ে তুলছে এই চাঁদা, কেউ চাঁদা না দিতে চাইলে তাদেরকে মারধর করার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
হাজীগঞ্জ বাজারে তীব্র যানজট লেগে থাকার অন্যতম একটি কারণ হলো সড়কের উপর এই সব অবৈধ সিএনজির স্ট্যান্ড। সড়কের দুই পাশেকে স্ট্যান্ড বানিয়ে তোলা হচ্ছে চাঁদা। এতে সড়ক সংকুলান হয়ে যাওয়ায় বাজারে লেগে থাকে তীব্র যানজট। আর এতে যাত্রীদের তীব্র ভোগান্তি পোহাতে হয়। অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের বেশ কিছু অসাধু কর্মকর্তার সাথে স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগশাযোশে চলে এসব অবৈধ স্ট্যান্ড।
সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলা আইন-শৃঙ্খলার মিটিংয়ে হাজিগঞ্জ- শাহরাস্তি সংসদী আসনের সংসদ সদস্য মেজর ( অবঃ) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম সড়কের চাঁদাবাজীর বন্ধের নির্দেশ দিলেও এখনো বন্ধ হয়নি এসব চাঁদাবাজি।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাজিগঞ্জ বাজারের বিশ্বরোড চৌরাস্তা থেকে পৃর্ব বাজার ব্রিজ পর্যন্ত ৭৫০ মিটার সড়কের মধে ৮টি সিএনজি ও অটোরিক্সার অবৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে। শুধু বিশ্বরোড এলাকাতে তিনটি অবৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে।
দেখা যায়, হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজার থেকে চাঁদপুর লঞ্চঘাট ও বড় স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া সিএনজির স্ট্যান্ডের লাইনম্যান মো. মোস্তফা নামে একজন। প্রতিটি সিএনজি থেকে স্ট্যান্ড খরচ দেখিয়ে চাঁদা রাখা হয় ২০ টাকা। এই স্ট্যান্ডে প্রতিদিন প্রায় তিন শতাধিক সিএনজি গাড়ি থেকে উত্তলন হচ্ছে ৭/৮ হাজার টাকা চাঁদা আদায়।
হাজীগঞ্জ থেকে রামগঞ্জ – লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া সিএনজি স্ট্যান্ড দেখভাল করে সুজন নামে একজন। প্রতিটি সিএনজি থেকে রাখা হয় ২০ থেকে ৩০ টাকা। জানা যায়, যেসব সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি চালাচল করে সেগুলো থেকে দৈনিক ৩০ টাকা করে রাখা হয়। আর যে সব সিএনজি লোকাল যাত্রী নিয়ে যায়। সেই সব প্রতিটি সিএনজি থেকে ১০/২০ টাকা করে রাখা হয়। এই স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ৫-৬ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
হাজিগঞ্জ বিশ্বরোড থেকে কচুয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া স্ট্যান্ড দেখভাল করে টিটু ও সোহাগ। প্রতিটি সিএনজি থেকে রাখা হয় ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা। এই স্ট্যান্ড চাঁদা আদায় হয় দৈনিক ৪-৫ হাজার টাকা।
এই ছাড়াও শেখ সিটির সামনে থেকে কাশেমপুর মোল্লাডহরসহ আশেপাশের এলাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার সিএনজির স্ট্যান্ডটি নিয়ন্ত্রণ করে খবুল কাশেম নামে একজন। এই স্ট্যান্ড দৈনিক ৪-৬ হাজার টাকার চাঁদা আদায় হয়।
হোটেল শেরাটনের পাশে স্থাপন করা হয়েছে আরো একটি সিএনজি স্ট্যান্ড। যেখান থেকে সেন্দ্রা, বেলচোঁ, সমেষপুরের উদ্দেশ্যে সিএনজি ছেড়ে যায়। এই স্ট্যান্ডও দেখাভাল করে খোকন নামে একজন। এই স্ট্যান্ড দৈনিক ২-৩ হাজার টাকা চাঁদা আদায় হয়।
পালিশারা বাজারের উদ্দেশ্যে হোটেল শেরাটনের পাশে শেখ মার্কেটের সামনে থেকে ছেড়ে যায় দৈনিক ৩০/৩৫ টি সিএনজি। তা থেকে ২০ টাকা করে টাকা উত্তলন করেন রাজু।
ডিগ্রি কলেজ রোডস্থ ব্যাংক এশিয়া সামনে থেকে মনতলা, চালিয়াপাড়া, ফকির বাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় প্রায় দুই শতাধিক সিএনজি। তাদের নির্ধারিত ২০ টাকা করে চাঁদা নেন লাইনম্যান খালেক কাশারী।
আল-মদিনা হোটেলের সামনে থেকে রামপুর, সাহেব বাজারের উদ্দেশ্যে ছাড়ে প্রায় শতাধিক গাড়ী। আর তা থেকে হাজার হাজার টাকা চাঁদা উত্তলন করেন মোস্তফা কাশারী।
স্টেশন রোড থেকে ফিরোজপুর, কালচোঁ, কাঁঠালি ও তার আশেপাশে এলাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেওয়া সিএনজি স্ট্যান্ডটি নিয়ন্ত্রণ করেন সবুজ কাশারী ও খোকন। প্রায় শতাধিক সিএনজি থেকে ২০ টাকা করে এই স্ট্যান্ডে দৈনিক ৪/৫ হাজার টাকা আদায় হয়।
পূর্ব বাজারস্থ টপ টেনের শোরুম এর পাশে স্ট্যান্ড থেকে মোহাম্মদপুর, আহমাদপুর, কাশেমপুর, দেশগাঁও এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সিএনজি। এই স্ট্যান্ডের দেখাশোনা করে মিঠু কাজীর আন্ডারে চালায় জাহাঙ্গীর । এখানে দৈনিক ২০ টাকা হারে আদায় করা হয় চাঁদা। প্রতিদিন ৩/৪ হাজার টাকা চাঁদা আদায় হয়।
থানা রোডে অবস্থিত স্ট্যান্ড থেকে রঘুনাথপুর ও আশেপাশের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সিএনজি। এই স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে শাহ আলম ও পেয়ারে লাল। এখানে দৈনিক ৪-৫ হাজার টাকা চাঁদা আদায় হয়।
ছোট মসজিদের উত্তরে মাঠ থেকে ধড্ডা, সুহিলপুর বাজারে ছেড়ে যায় প্রায় ৩০/৩৫ টি সিএনজি। তাও মমিনসহ একই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।
এই ছাড়াও উপজেলার বলাখাল বাজারে দুইটি অবৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে। যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা নাসির। বাকিলা বাজারে প্রভাবশালীরা সড়কের উপরে বানিয়েছে দুটি অবৈধ স্ট্যান্ড। যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে নাসির, শরিফ, মানিক, রনি, মাসুদ। কৈয়ারপুরেও অবৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে। এনায়েতপুর রয়েছে আরো একটি অবৈধ সিএনজির স্ট্যান্ড। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য অবৈধ সিএনজির স্ট্যান্ড। যেগুলো থেকে প্রতি মাসে তোলা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
এই সব স্ট্যান্ডের বেশ কয়েকজন ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই চাঁদা নেওয়া হয় স্ট্যান্ডের সিরিয়াল ম্যানটেইন করার কথা বলে। এই টাকা ভাগের একটি অংশ যায় প্রশাসনের কাছে, একটি অংশ যায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এবং একটি অংশ পায় যারা এই টাকা উত্তলন করে।
এই সব অবৈধ স্ট্যান্ডে চাঁদ আদায় করার বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা কোন কথা বলতে রাজি হয়নি।
সড়কের উপর এই সব অবৈধ স্ট্যান্ডের বিষয়ে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ( টিআই) বোরহানউদ্দিন বলেন, এসব অবৈধ স্ট্যান্ড ও বাজারের মালামাল আনলোড করার যে ট্রাকগুলো রয়েছে। এগুলো বন্ধ হোক আমি চাই। আমি এগুলো বন্ধ করার জন্য সর্বোচ্চ কাজ করছি। উপজেলা প্রশাসন যদি হেল্প করে আমি আমার সর্বোচ্চটুকু চেষ্টা দিয়ে করব এসব অবৈধ স্ট্যান্ড বন্ধ করার।
হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রশিদ বলেন, প্রশাসনের চোঁখে দুলো দিয়ে প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। আমি ইতিমধ্যে সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে উত্তলন কারী কয়েকজন লাইনম্যানকে থানায় ধরে এনেছি। সবগুলো সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে কেউ আর কোন টাকা উঠাতে পারবে না, সেই বিষয়ে আমরা সজাগ থাকবো।
এই বিষয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তাপস শীল বলেন, যে সকল অবৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে থানা পুলিশ ও পৌরসভার সমন্বয় করে এসব অবৈধ স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইতিমধ্যে কার্যক্রম চালিয়েছি।
প্রতিবেদক: জহিরুল ইসলাম জয়,৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪