Home / উপজেলা সংবাদ / হাজীগঞ্জ / হাজীগঞ্জে শীতের শেষ সময়েও খেজুরের রস সংগ্রহে গাছিদের কর্মব্যস্ততা

হাজীগঞ্জে শীতের শেষ সময়েও খেজুরের রস সংগ্রহে গাছিদের কর্মব্যস্ততা

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে শীতের শেষ সময়েও ব্যাপক চাহিদা থাকায় খেজুরের রস সংগ্রহে গাছিদের কর্মব্যস্ততা দেখা যায়। গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি মৌসুম শীতের তীব্রতা চলমান থাকায় আরো মাসখানেক রস সংগ্রহের আশাবাদ স্থানীয় গাছিদের।

এক সময় গ্রামের মাঠে আর মেঠো-পথের ধারে সারি সারি খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে থাকতো। এতে দৃষ্টিনন্দন ও সৌন্দর্য্যবর্ধনের পাশাপাশি শীতকালে খেজুরের রস সংগ্রহ ও রসের তৈরি পিঠা-পায়েস, গুড় আর মুরি-মুড়কিতে উৎসব আনন্দে ভরে উঠতো গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়ি-ঘর। কিন্তু কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে সেই দিনগুলো। অনেকটা বিলুপ্তির পথে সেই খেজুর গাছ ও খেজুরের রস।

এর কারণ হিসেবে স্থানীয়রা প্রাকৃতিক কারণ, জ্বালানির জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা, গ্রামীণ রাস্তা প্রস্তস্থকরণ, আবাদি জমি এবং রাস্তার পাশে বসতভিটা ও দোকানঘর নির্মাণ, আবার এখনো যে কটি গাছ রয়েছে, তার রক্ষণাবেক্ষণ, গাছি না পাওয়া, গাছ থেকে রস চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কারণেও অনেকে খেজুর গাছ কেটে অন্য গাছ রোপণ ও নতুন করে খেজুর গাছের চারা রোপণ না করাকে দায়ী করছেন।

শীতের এ মৌসুমে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামের মাঠে আর মেঠোপথের ধারে এখনো কিছু গাছ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। এর মধ্যে রাজারগাঁও, বাকিলা, কালচোঁ উত্তর, কালচোঁ দক্ষিণ, বড়কুল পূর্ব, বড়কুল পশ্চিম, হাটিলা পূর্ব, হাটিলা পশ্চিম, গন্ধর্ব্যপুর উত্তর, গর্ন্ধব্যপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন দ্বাদশগ্রাম ইউনিয়নে কিছু কিছু স্থানে রস সংগ্রহে কাজ করতে দেখা যায় গাছিদের। খেজুরের গাছে গাছে এখন রস নেয়ার জন্য কলস, মাটির হাড়ি কিংবা প্লাস্টিকের ডোগ বসানো। এভাবে রস সংগ্রহে দেখা যায় গাছিদের একাধিক ব্যস্ততা।

দেখা যায়, গাছের ওপরের ঠিক বুকের দিকটার নির্দিষ্ট স্থানে কাটা অংশ পরিষ্কার করে আবার সামান্য কেটে বিকেলেই বসানো হয় রসের পাত্র। বিকেল গড়িয়ে রাত ৯টা ১০টা হলে ওই পাত্র ভরে যায় রসে।

রস নিয়ে সে পাত্র খালি করে আবার বসানো হয়। মধ্যরাতে ও সকালে আবার চলে রস সংগ্রহ। এভাবেই এখন খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত দিন-রাত যাচ্ছে হাজীগঞ্জ উপজেলা গাছিদের।

এখানকার সব ব্যস্ততা যেন এখন শুধু তাদেরই। বরাবরের মতো এবারও শীত মৌসুমের পুরোটা সময় এভাবেই ব্যস্ত থাকতে হবে গাছিদের।

স্থানীয়রা জানান, গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তারপরও যে কয়টা গাছ রয়েছে, তার মধ্যে কিছু গাছের পরিচর্যা করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে অনেকে। দেখা গেছে, যে কয়টা গাছ আছে তার মধ্যে কিছু গাছ রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কিছু গাছ পরিচর্যাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। আবার গাছির অভাবে কিছু গাছ রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা যায়নি।

উপজেলার দ্বাদশগ্রাম ইউনিয়নের আবুল কালাম নামের সত্তরোর্ধ্ব একজন বৃদ্ধ বলেন, কাঁচা রসের পায়েস খাওয়ার কথা এখনো মনে পড়ে। আমাদের নাতি-নাতনীরা তো আর সেই খেজুরের রস, রসের তৈরি গুড়, পিঠা-পুলি ও পায়েস, দুধ-চিতই খেতেই পায় না। তারপরও বছরে অন্তত একবার হলেও রসের তৈরি পায়েস রান্নার চেষ্টা করি।

পৌরসভাধীন টোরাগড় গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আনোয়ার হোসেন আনু জানান, এক সময় এক হাড়ি খেজুর রস কিনতাম ২০ টাকা দিয়ে। ৫/৭ বছর আগেও ২০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। কিন্তু এখন খেজুর গাছ না থাকায় সে রসের দাম বেড়ে ৬০০ টাকা হয়েছে।

বাকিলা ইউনিয়নের দিঘই গ্রামের গাছি মো. সফি উল্যাহ জানান, আশ-পাশে গ্রামের গাছগুলো রসের জন্য তিনিই প্রস্তুত করে থাকেন। বিনিময়ে একদিন পর-পর তিনি ও গাছের মালিক পক্ষ রস নিয়ে থাকেন। অর্থাৎ মাসের পনের দিন রস তিনি নেন এবং পনের দিন গাছের মালিক পক্ষ নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, এক হাঁড়ি রস ৬শ’ টাকা বিক্রি হয়। আর এক হাঁড়িতে ৫ লিটার রস থাকে বলে তিনি জানান।

এমনই পড়ন্ত বিকালে হাজীগঞ্জ রামগঞ্জ সড়কের পাশে জয়শরা গ্রামে খেজুর রস সংগ্রহে মগ্ন গাছি সোলেমান জানান, ‘এবারের মৌসুমে ১৫ টি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতেছি। এ গাছগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লিটার রস আসে। শীত যখন আরও বাড়বে তখন টার্গেট হবে দৈনিক ৫০’শ লিটার রস সংগ্রহ। প্রতি লিটার রস খুচরায় বিক্রি হয় ১শ’ টাকা করে। আর পাইকারি বিক্রি হয় ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়।

তিনি আরো জানান, গত মৌসুমে রস বিক্রি করে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করেছেন। এবার আরো বেশি হতে পাড়ে যদি শীতের প্রকট বাড়ে ।

পশ্চিম দেশগাঁও ব্রিজ সংলগ্ন গাছি আলতাফ মিয়া জানান, প্রায় ৪০টি গাছ কেটেছি যা থেকে দৈনিক ৩৫ থেকে ৪০ লিটার রস পাচ্ছি। শীতের প্রকট বাড়ার সাথে সাথে রসের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত রস সংগ্রহ চলবে বলে জানান গাছিরা।

চলমান আবহাওয়ায় তাদের রস দিয়ে গুড় তৈরি করা যায় না। আর তেমন ভাবে এখানকার কোনো বড় ব্যবসায়ীরা আসেন না রস সংগ্রহের জন্য। তাছাড়া আমাদের যে রস সংগ্রহ হয় তা’দূর দূরান্ত থেকে গ্রাহকরা অগ্রিম টাকা দিয়ে নিয়ে যায়।

গাছিরা আরো জানায়, রস বিক্রিতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না। বড় সমস্যা হচ্ছে এখানকার কিছু স্থানীয় চোর রস নিয়ে যায়। সে সাথে হাড়িটাও ভেঙ্গে ফেলে দেয়। তবে দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় পূর্বের মত রস সংগ্রহ হচ্ছেনা ।

এলাকার গাছিদের সঙ্গে কথা বলে যে সংখ্যাটা জানা যায় তা হল, পুরো উপজেলার প্রায় ছোট বড় এক হাজার গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হচ্ছে। এবার শীতের সময়টা একটু বেশী সময় ধরে চলমান থাকায় রস সগ্রহের চাহিদা বেড়েছে। 

প্রতিবেদক: জহিরুল ইসলাম জয়,১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪