হাজীগঞ্জে বন্যার পানিতে মাছ ধরার হিড়িক

২০০৪ সালের বন্যার পর প্রায় বিশ বছর পর ২০২৪ সালে আবার দেখা দেয় বন্যা। সেই সুযোগে গ্রামের খাল বিলে মাছ নিধনের চেষ্টায় জাল ও টেঁটা নিয়ে সাধারণ মানুষের বিচরণ দেখা যায়। যে কারনে হাজীগঞ্জ উপজেলাসহ বিভিন্ন হাট বাজারে জাল ও টেঁটার দোকানে মানুষের হিড়িক পড়তে দেখা যায়।

ইতিমধ্যে দেখা যায়, বন্যার পানির সঙ্গে দেশীয় ও চাষের মাছের অবাধ বিচরণ। নদী উপচে খাল-বিল, মাঠ ও ফসলি ক্ষেতে পানি প্রবেশ করে সেই সঙ্গে চলে আসে মাছও। আর সেই বন্যার পানিতে মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যায়। তাছাড়া বর্ষায় বৃষ্টির ছোঁয়ায় বদলে যায় প্রকৃতি। আষাঢ়ের শেষের দিকে খাল, বিল, নদী, নালাসহ চারিদিকে পানি থাকে টইটম্বুর। বর্ষার এই নতুন পানিতে দেশি মাছ ডিম পাড়া শুরু করে। ফলে দেশি মাছের বিচরণে ভরে ওঠে নদীনালা।

দেশি মাছের স্বাদ নিতে মুখিয়ে থাকে গ্রামাঞ্চলের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। এ সময়টিতে চাই (মাছ ধরার দেশীয় ফাঁদ) পেতে, উড়ো জাল ও টেঁটা দিয়ে মাছ ধরতে চায় গ্রামের সবাই। ফলে প্রতি বর্ষা গ্রামে নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ। আর এই উৎসবকে আরও জমজমাট করে তুলতে মৌসুমি আয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন চাই, জাল ও টেঁটার কারিগর ও বিক্রেতারা। চাহিদার সামাল দেওয়ার পাশাপাশি এটি হয়ে উঠছে তাদের বাড়তি আয়ের পথ।

এ বছর ভাদ্রের শুরুতেই দেশের কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। তাইতো বর্ষা আর বানের এই পানিতে অনেকটা প্লাবিত চাঁদপুরের উপজেলাগুলো। বন্যা না হলে চাঁদপুরের ৮টি উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা পানিতে টইটুম্বুর। এতে বিপাকে পড়েছেন মাছ চাষি এবং মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদনকারীরা। জেলার যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে ওই এলাকার বেশিরভাগ পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে।

এ সময়টাতে চারপাশে পানি থাকায় কমে গেছে দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষের কাজ। এতে মাছ চাষি এবং মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদনকারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জেলেসহ পেশাদার ও সৌখিন মাছ শিকারীদের পৌষ মাস চলছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, ভেসাল জালসহ নানা প্রকার জাল ও বাঁশের চাঁই (দোয়াইর), ঘুণি ও বড়শি পেতে এবং টেঁটা দিয়ে মাছ ধরছেন জেলেসহ পেশাদার ও সৌখিন মাছ শিকারিরা।

সরেজমিনে গত রোববার ও সোমবার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন খাল-বিল ও ফসলি মাঠসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে আছে। অনেক গ্রামের বাড়ির উঠানেও পানি। রাস্তার পাশ দিয়ে, বাড়ি-ঘরের আশপাশে মাছ ধরার ফাঁদ পেতে রেখেছেন স্থানীয়রা। অনেকে জাল পেতেও মাছ ধরছেন। এতে গ্রামাঞ্চলের অনেকেই মাছ ধরার কারণে ক্রেতার সংখ্যা কিছুটা কম। যার ফলে তুলনামূলকভাবে অনেকটা কম দামেই মাছ বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে দেখা গেছে, জাল, বড়শি ও টেঁটার দোকানে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভীড়। সুযোগ বুঝে দাম বেশি নেওয়ার অভিযোগ জানান ক্রেতারা। তবে ব্যবসায়ী ও টেঁটার কারিগর এবং ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির কথা অস্বীকার করেন। ব্যবসায়ীরা বলেন, যেই দামে কেনা, সে হিসেবে বিক্রি। টেঁটার কারিগররা বলেন, জিনিসপত্রের (উপকরণ) দাম বেশি, তাই খরচও বেশি। যার ফলে কাস্টমারের কাছে দামও একটু বেশি মনে হয়।

অপরদিকে মাছ শিকারীসহ বিভিন্ন হাট-বাজারের আড়ৎ ঘুরে দেখা গেছে, বড় মাছের চেয়ে পোনা মাছ সংখ্যা এক তৃতীয়াংশ। দামও কিছুটা কম। ইমাম হোসেন নামের একজন মাছ বিক্রেতা জানান, বানের পানির কারণে মানুষের পুকুর ভেসে গেছে। যার কারণে পোনা জাতীয় মাছ বেশি ধরা পড়ছে।

এদিকে বর্ষা ও বানের পানির কারণে গ্রামাঞ্চলের পথঘাট ডুবে যাওয়া এবং অনেকের বাড়িতে উঠানে জলাবদ্ধতার কারণে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন লোকজন। এতে প্লাবিত এলাকার শ্রমজীবী মানুষেরা বিপাকে পড়েছেন। সরকারিভাবে এবং ব্যক্তি উদ্যোগে সহযোগিতা করা হলেও, চাহিদার তুলনায় তা নগণ্য বলে জানান অনেকে।

মুন্সী মোহাম্মদ মনির নামের হাজীগঞ্জের একজন মাছ চাষি এবং পোনা উৎপাদনকারীর সাথে। তিনি জানান, তার ১০/১২টি পুকুর রয়েছে। এরমধ্যে সবগুলো পুকুর তিনি লিজ (ভাড়া) নিয়ে মাছ চাষ ও পোনা উৎপাদন করে থাকেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যা এবং বর্ষা ও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে তারসহ শত শত মাছ চাষি ও পোনা উৎপাদনকারীর পুকুর ভেসে গেছে। এতে তিনি আর্থিকভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

আলী আহম্মদ নামের একজন সৌখিন মাছ শিকারী বলেন, চারদিকে পানি আর পানি। তাই, জাল পেঁতেছেন এবং উড়ো জাল মেরে মাছ শিকার করছেন।

গনি মিয়া নামের একজন মাছ শিকারী বলেন, আমি সবসময় টেঁটা দিয়ে মাছ শিকার করে থাকি। তবে বিক্রি করি না। যা পাই, তা দিয়ে নিজেরা রান্না করে খাই। এতে মাছ কেনার খরচ বেচে যায়।
ভেসাল জাল দিয়ে মাছ শিকারী মন্নান নামের একজন বিক্রেতা জানান, এ বছর চারদিকে পানি থাকায় বেশি মাছ ধরা পড়ছে। তিনি বলেন, বড় মাছের তুলনায় পোনা বেশি পাচ্ছি।

আবুল হোসেন নামের একজন টেঁটা বিক্রেতা সাথে কথা হলে তিনি জানান, বাজারে টেঁটার প্রচুর চাহিদা। প্রকার ভেদে একটি টেঁটা ৩০০ টাকা থেকে ১০০০/১২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।
তপন সাহা নামের একজন জাল, নেট ও রশি (দঁড়ি) বিক্রেতা জানান, আমরা বেশি দামে বিক্রি করছি না। যেই দামে আমরা মাল কিনছি, সে হিসেবেই বিক্রি করছি। তারা বলেন, প্রশাসন ও ছাত্ররা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছেন।

মোশারফ হোসেন নামের একজন শ্রমজীবী জানান, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে তার পরিবারের সদস্য ৫ জন। এর মধ্যে তিনি ও তার এক সন্তান প্রতিবন্ধী। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও কাজ করে খান। কিন্তু চারদিকে পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এমনকি বাড়ির উঠানেও পানি থাকার ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন।

এদিকে উপজেলা মৎস্য অফিসের কোন অভিযান না থাকায় নিষিদ্ধ রিং জাল, কারেন্ট জাল, ভেসাল জালের মাধ্যমে ছোট বড় মাছ নিধনের হিড়িক পড়েছে।

প্রতিবেদক: জহিরুল ইসলাম জয়, ২৭ আগস্ট ২০২৪

Share