সময় তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার বাকিলা বাজারের হক ফার্মেসিতে রোগীর উপস্থিতি বেড়েই চলছে। তবে এ উপস্থিতি ঔষধ কিনতে নয়। বিভিন্ন বয়সের রোগীরা এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। তারা সারিবদ্ধ চেয়ারে বসে ডাক্তার সাহেবের সিরিয়াল পাবার অপেক্ষা করছেন। তাদের মধ্যে গর্ভবতী মহিলাও রয়েছেন।
সামনে কাউন্টারের ভেতরে বসে মাধ্যবয়সী একজন পুরুষ রোগীর, জ্বর, প্রেসার, শ্বাসপ্রশ্বাস মেপে দেখছেন। রোগীর চোখ-মুখ পরিক্ষা করে প্রেসক্রিপশন লিখে ঔষদ বুঝিয়ে দিচ্ছেন তিনি। সিরিয়াল পেতে আমাদেরও বেশ সময় অপেক্ষা করতে হলো।
এরমধ্যে হঠাৎ চোখ পড়ে ফার্মেসির ভেতরে থাকা একটি গোপন দরজার দিকে। পাশে বসা একজন রোগী চাঁদপুর টাইমসকে জানান, দরজার ওপাশে রয়েছে তিন শয্যার একটি মিনি হাসপাতাল। যেখানে গর্ভবতীসহ নারী রোগীদের আলাদা চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।
এক পর্যায়ে চাঁদপুর টাইসের সাংবাদিকের সাথে কথা হয়, ‘কথিত সর্বরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ঔষধ ব্যবসায়ী মো. মনির হোসেনের সাথে। প্রথমেই স্বীকার করেন, তিনি কোন এমবিবিএস ডিগ্রীধার চিকিৎসক নন। উল্লেখযোগ্য তেমন কোন চিকিৎসা সনদও নেই তার। তবে নিজেকে চাঁদপুরের কোন এক প্রতিষ্ঠান থেকে ডিএমএস সনদধারী চিকিৎসক বলে দাবী করেন। আর এ সনদ দিয়েই বিশাল ফার্মেসি খুলে দিচ্ছেন সর্বরোগের চিকিৎসা। নিজের নামে ছাপানো প্রেসক্রিপশনে লিখছেন অ্যান্টি-বায়োটিক মেডিসিনও।’
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, হাজীগঞ্জ বাকিলা বাজারের ঔষদ ব্যবসায়ী মো. মনির হোসেন এখন ওই ওলাকার অনেক বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। নিজেকে সর্বরোগের বিশেষজ্ঞ দাবী করে চিকিৎসা বানিজ্যের রামরাজত্ব কায়েম করেছেন। নিজের মালিকানাধীন বহুতল ভবনে খুলেছেন বিশাল ঔষদের দোকান। যেখানে দালাল মাধ্যমে প্রতিদিন শত শত রোগী আসছে। যাদের কাছ থেকে তিনি ভিজেট, ঔষদ বিক্রি এবং অপ্রয়োজনীয় পরিক্ষা-নিরিক্ষার কমিশনসহ তিন ধাপে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
আগত বেশ ক’জন রোগীর সাথে কথা হলে চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘যে কোন অসুখ হলেই তারা মুনির ডাক্তারের ওষুধের দোকান-কাম চেম্বারে চলে আসেন। মুনির ডাক্তারকে মেডিসিন, শিশু, গাইনী, চর্ম-যৌন, নাক-কান-গলাসহ সকল রোগের বিশেষজ্ঞ বলে জানেন তারা। পরিক্ষা-নিরিক্ষার প্রয়োজন হলে কথিত এ ডাক্তারের দেয়া টোকেন বা ছোট্ট কাগজ নিয়ে যেতে হয় তার নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। আশপাশে ভালো কোন চিকিৎসক কিংবা হাসপাতাল না থাকায় বাধ্য হয়েই মুনির ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান তারা।’
এ বিষয়ে হক ফার্মেসির মালিক ও কথিত সর্বরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মো.মনির হোসেন চাঁদপুর টাইমসেক বলেন, ডিএমএস ডিগ্রিধারী পল্লী চিকিৎসকরা সকল লোকের চিকিৎসা দিতে পারেন এবং প্রেসক্রিপশন লিখে অ্যান্টি-বায়োটিক মেডিসিনও দিতে পারেন। ডিএমএস ডিগ্রিধারীরা চিকিৎসা দিতে পারবে না, কিংবা প্রেসক্রিপশন লিখে ঔষধ দিতে পারবে না, এমন কোন সরকার নীতিমালা নেই।
এক পর্যায়ে এ বিষয়ে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, আমি হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং সিভিল সার্জনসহ স্বাস্থ্য বিভাগের অনেক বড় বড় কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেছি। এ বিষয়ে তারাও সরকারি কোন নীতিমালা দেখাতে পারেনি। ডিএমএস ডিগ্রি দিয়েই নিজেকে চিকিৎসক এবং সর্বরোগের চিকিৎসা দেওয়ার রাইট আছে দাবি করে বলেন, আপনারা পেপারে লেখেন, টিভিতে দেখান, এতে আমার কিছুই হবে না।এই বাজারে মা ফার্মেসি, বিসমিল্লাহ ফার্মেসি, কার্তিক ফার্মেসিসহ অনেক ঔষধের দোকানে প্রেসক্রিপশন লিখে চিকিৎসা দেয়া হয়।’
এ বিষয়ে হাজিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. গোলাম মাওলা নঈম চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, কোন রেজিস্টার ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ কোন প্রকার প্রেসক্রিপশন লিখতে পারবে না। বর্তমানে কিছু কিছু জায়গায় দেখা যাচ্ছে ডিপ্লোমাধারী কিছু ফার্মাসিস্ট চেম্বার খুলে রোগী দেখছেন এবং প্রেসক্রিপশন লিখছেন। যেটা সম্পূর্ণ বে-আইনি। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে তথ্য প্রমাণসহ অভিযোগ আসলে ব্যবস্থা নিবো।
চাঁদপুর জেলা বিএমএ এর সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার মাহমুদুন্নবী মাসুম বলেন, এমবিবিএস ডাক্তার ছাড়া কেউ এ ধরনের প্রেসক্রিপশন লিখতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সজাগ থাকতে হবে। যাতে করে সাধারণ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়।
সচেতন মহলের দাবি, এসকল বিষয়ে দেখবাল করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। অথচ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ফার্মেসিগুলোতে নামে বেনামে চেম্বার খুলে বসে প্রেস্ক্রিপশন করছে। ফলে তারা এসব বিষয়ে কোন প্রকার তদারকি কিংবা অভিযান চালাচ্ছে না। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
প্রতিবেদক: আশিক বিন রহিম, ২৩ নভেম্বর ২০২২