হাজীগঞ্জের হামিদিয়া জুট মিলটি হাজীগঞ্জ তথা চাঁদপুরবাসীর বর্তমান নতুন প্রজন্মের কাছে এখন একটি রূপকথার গল্প। বিস্তৃত খোলা একটি মাঠ থাকলেও সেখানে হাজীগঞ্জ হামিদিয়া জুট মিলটির কোনোই অস্তিত্ব নেই। ক’টি বালু বাহী ট্রাক নিবিড়-নির্ভৃত পরিবেশে চালকদের বিশ্রামকালীন সময়ে দেখা যায়।
অথচ একসময়ে এখানে তাঁতের ঝন ঝনানিতে কান বধির হযে আসত। শত শত শ্রমিকদের পদচারণায় থাকত মুখরিত। মালিক ও কর্মকর্তাগণ আসা-যাওয়া করত সানন্দে। বদলীওয়ালা শ্রমিকদের মনে ছিল আনন্দ।
সপ্তাহশেষে যা মাইনে পেত-তা দিয়ে বাজার-সদা নিয়ে বাড়ি যেত। তিন সিফটটে তারা কাজ করত। এতে এলাকাটি থাকত সব সময়েই প্রাণচাঞ্চল্য। এখন শুধুই খালি বিশাল মাঠ। সারি সারি নারকেল গাছ আর নানাবিধ ফল-ফলাদির গাছ যা ছিল -এখন তাও নেই। শত শত পাটবোঝাই মাঝি-মাল্লা আসা-যাওয়া করত।
যতদূর জানা গেছে-১৯৬১ সালে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের টোরাগড় এলাকায় ১৭ একর জমির ওপর হামিদিয়া জুট মিল নামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সব মিলে ১২শ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল।
২০০১ এটিকে ‘হাজীগঞ্জ স্পিনিং জুট মিলস ’ নামকরণ করা হয়। স্বাধীনতার পর মিলটি চালানোর জন্য অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংকটি দীর্ঘদিন চালানোর পর বিভিন্ন কারণে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বাজার আর্ন্তজাতিকভাবে হ্রাস হওয়ায় সারাদেশের পাটের মিলগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। যার নেতিবাচক প্রভাব দেশের সব জুট মিলগুলোর ওপর পড়ে। এক সময় আমাদের দেশের এশিয়ার সর্ববৃহৎ আদমজী জুট মিলটিও নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ স্পিনিং জুট মিলটি অর্থাভাব ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় বছর জুড়ে বন্ধ রয়েছে। প্রায় এ সময় ৪শ’ শ্রমিক বেকার হয়ে যায়। মিলটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিছ্ন্নি থাকায় ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছিল। চুক্তিভিত্তিক বেতনে ৮-১০ জন গার্ড দিন রাত পাহাড়া দিয়ে যাচ্ছে। ২০০১ সালে স্থানীয় জনৈক শিল্পপতি হাজীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংক শাখা থেকে নিলামে ক্রয় করার পর কিছুদিন মিলটি চালানোর পর বন্ধ করে দেন।
প্রায় ৩-৪ বছর বন্ধ থাকার পর তিনি ভাড়ায় মিলটি চালাতে অপর একজন ব্যক্তিকে ভাড়া দেন। অত:পর তিনিও কিছুদিন চালানোর পর মিলটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে খোলা-বন্ধ পর্ব চলার পর পুনরায় জনৈক দু’ব্যবসায়ী মাসিক ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ভাড়ায় চালানো পর আবার মালিকের ভাড়া, ক্রয়কৃত পাটের মূল্য, শ্রমিকের বেতন, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করতে পেরে মিলটি সচল রাখতে ভাড়াটিয়া দিশেহারা হয়ে পড়ে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করতে পারায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার কারণেই মিলটি বন্ধ হয়ে যায়।
এর পর অপর একজন ব্যবসায়ী আবার ৪ মাস ভাড়ায় চালানোর পুনরায় মিলটি বন্ধ হয়ে যায় । গার্ডদের প্রধান ও তদারকির দায়িত্ব মোস্তফা কামাল সর্বশেষ অবস্থার কথা জানান,‘ অর্থাভাব ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় হাজীগঞ্জ স্পিনিং জুট মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিভাগে আগাম জমা দিয়ে মিলটি চালানো হয়েছিলো বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া মালিককে সংশ্লিষ্ঠ বিদ্যুৎ বিভাগ পুনরায় আগাম হিসেবে আরো ১৫ লাখ টাকা জমা দেয়ার কথা জানিয়েছেন।’ তবে যতোদিন মিলটি চালু ছিলো-ততোদিন পাটের সুতা,কপ,পিজিশন তৈরি হচ্ছিলো। বাজারে এর বেশ চাহিদাও ছিলো। তখন ১ শ’৫০ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজে নিয়োজিত ছিল। এদের কাজ করার প্রচুর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভাড়াটিয়া মিলটি অর্থাভাবে ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় মিলটি চালাতে পারছেন না বলে সূত্রটি জানান। পাট ব্যবসায়ীরাও মিলে পাট বাকিতে দিতে রাজি হচ্ছোলেন না।
মিলটি চালু না থাকায় প্রায় ৪শ’ শ্রমিক এখন বেকার হয়ে পড়ে। বর্তমানে দেশের ১৮টি উৎপন্ন দ্রব্যের বাজারজাত করণে প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে চটের তথা পাটের ব্যাগ বা বস্তা ব্যবহার সরকার বাধ্যতামূলক করে। এদিকে সরকারিভাবে প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করায় পাটের ব্যবহৃত ব্যাগ বা বস্তার চাহিদা বাজারে প্রচুর। সরকারিভাবে ধান, চাল ও চাষীদের আলুর মৌসুমে মিলটির উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্ত মিলটি বন্ধ থাকায় শ্রমিকরাও এখন বেকার জীবন যাপন করছে।
প্রসঙ্গত,পাট চাষ ও পাটশিল্প আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। বাংলার পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে পাট ও পাটশিল্প। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে পাট শিল্পের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে দেড় যুগ পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল প্রধান রপ্তানিকারক পণ্য। আজও আমাদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে পাট ও পাটশিল্প।
এ শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার সংগ্রাম গড়ে তোলা আমাদের একটা জাতীয় দায়িত্ব। আমাদের পাটশিল্পের ক্রম অবনতির বিপরীতে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্পের অগ্রযাত্রার ইতিহাস। বাংলাদেশে ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিলো ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট। এতে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পাটের ব্যবহার বাড়ানোর নির্দেশনা ছিল। সরকার ঔ অ্যাক্ট বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে পারে নি।
লেখক : আবদুল গনি , শিক্ষক,প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী, চাঁদপুর । ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩। ০১৭১৮ ২১১ ০৪৪ ।