সারাদেশ

হাজার মানুষের সামনেই খুন হলো নাজিমুদ্দিন সামাদ

‘প্রথমে নাজিমুদ্দিনের মাথায় কোপ, পরে গুলি করে’

রাতে বন্ধু সোহেলের সঙ্গে হেঁটে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে মেসের দিকে যাচ্ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্র ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ। রাত তখন আনুমানিক সাড়ে আটটা।

দুই বন্ধু সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে আসতেই হঠাৎ পাশথেকে দুই তরুণ হেঁটে তাদের সামনে আসে। কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন নাজিমুদ্দিনের মাথায় বসিয়ে দেয় এক কোপ। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রাস্তার উপর লুটিয়ে পড়েন নাজিমুদ্দিন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন বন্ধু সোহেল। দৌড়ে রাস্তার অপর পাড়ে গিয়ে সোহেল দেখেন আরও তিনজন তরুণ এসে নাজিমুদ্দিনকে ঘিরে ফেলেছে। যোগ দেওয়া ঘাতকরা নাজিমুদ্দিনের মাথায় বসিয়ে দেয় দু-একটি কোপ।

ঘাতক তরুণরা সবাই স্বাভাবিক পোশাকে ছিল। অর্থাৎ শার্ট, টি-শার্ট ও প্যান্ট, জানান নিহত নাজিমুদ্দিনের বন্ধু সোহেল।

তিনি বলেন, ‘‘আমি রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে খুনিদের উদ্দেশ করে বলি ‘আপনাদের কোনো ভুল হচ্ছে। ও (নাজিমুদ্দিন) কোনো কিছু করেনি। আপনারা কোথাও ভুল করছেন।’ এমন সময় খুনিদের মধ্যে একজন পিস্তল বের করে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নাজিমুদ্দিনের মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে।”

ভয়াবহ এই ঘটনা দেখে জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে দৌড় দেন সোহেল।

তিনি বলেন, “কিছু দূর দৌড়ে যাওয়ার পর টহল পুলিশ দেখে আমি (সোহেল) তাদের বলি, ওইখানে (ঘটনাস্থলের দিকে ইশারা করে) একটি মার্ডার হয়েছে, ভাই দ্রুত যান। পুলিশ সদস্যরা আমাকে বলেন, ‘আপনি থানায় জানান।’”

সোহেল তাদের বলেন, “আমি কীভাবে জানাব। আপনারা আমার সঙ্গে চলেন, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি কোথায় মার্ডার হয়েছে। ‘আপনি যান আমরা দেখছি’ বলে পুলিশ সদস্যরা তখন ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দেন।”

এরপর সোহেল বুঝতে পারেননি তিনি কোথায় যাচ্ছিলেন। সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস দেখে তিনি তাতে উঠে বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। তার মাথায় শুধু খুনের ঘটনাটি ঘুরছিল।

বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রক্তের পাশাপাশি সেখানে মগজ পড়ে আছে।

পুলিশ বলছে, প্রশিক্ষিত ও পেশাদার খুনিরা পরিকল্পিতভাবে খুবই দ্রুততম সময়ে খুন করে পালিয়ে যায়।

স্থানীয়দের বরাত দিয়ে সূত্রাপুর থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আব্দুল আওয়াল জানান, বুধবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার দিকে তিন-চারজন যুবক এসে নাজিমুদ্দিনকে খুন করে পালিয়ে যায়। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাজিমুদ্দিনের এক ফেসবুক বন্ধু জানান, তিনি অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন। আওয়ামী লীগ সমর্থক হলেও লেখার মাধ্যমে বিভিন্ন সময় তিনি দলের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু, তনু হত্যাকাণ্ড নিয়েও নিজের মত প্রকাশ করেন।

নিহত নাজিমুদ্দিন জবির আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। লক্ষ্মীবাজারের কাছাকাছি একটি মেসে থাকতেন তিনি।

নাজিমুদ্দিনের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারে। তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদের সিলেট জেলা শাখার তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, মাথায় যেভাবে কোপের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে তাতে বলাই যায় যে, খুনিরা প্রশিক্ষিত ও পেশাদার। খুব কম সময়ের মধ্যে স্থানীয়রা বুঝে উঠার আগেই খুন করে তারা পালিয়ে যায়। মাত্র একটি গুলিতেই নাজিমুদ্দিনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে তারা। শুধু তাই নয়, এত তাড়াহুড়ার মধ্যে গুলি ঠিক মাথায়ই করা হয়েছে এবং আশপাশের দোকান খোলা থাকা অবস্থায় এত মানুষের সামনে হেঁটে এসে তারা নির্দ্বিধায় খুন করে চলে যায়।

সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন কুমার সাহা জানান, হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, খুনিরা প্রফেশনাল ও পরিকল্পিতভাবেই হত্যাকাণ্ডটি করেছে। তার মাথার খুলি ডান পাশ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে। এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তার পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় আসলেই মামলা করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনাস্থলের এক সেলুনের কর্মচারী জানান, আমরা শুধু একটি গুলির শব্দ শুনেছি। শোনার পর আতঙ্কে সেলুনে যারা ছিলাম, যে যেদিকে পেরেছি দৌড় দিয়েছি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, ধারণা করা হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত ও প্রতিশোধের জের ধরে। ঘটনাস্থল থেকে গুলির এক রাউন্ড খালি খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো কাউকে শনাক্ত কিংবা আটক করা যায়নি। তবে তার বন্ধু সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে হয়ত কোনো ক্লু পাওয়া যাবে।

||আপডেট: ০৯:২৮  অপরাহ্ন, ০৮ এপ্রিল ২০১৬, শুক্রবার

চাঁদপুর টাইমস /এমআরআর 

Share