চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার বাজাপ্তী রমনী মোহন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান শিকদারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনার শাসনামলে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি বহাল তবিয়তে ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, সুবিধামতো তিনি কখনো জামায়াত, কখনো বিএনপির সমর্থক হিসেবেও নিজেকে উপস্থাপন করছেন।
*বিদ্যালয়ের রাজনীতিকরণ*
বিদ্যালয়ের একাধিক অভিভাবকের অভিযোগ, ২০০৯ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে আব্দুল মান্নান বিদ্যালয়টির কার্যক্রমকে আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক করে তোলেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান নুর হোসেন পাটওয়ারীর সুপারিশেই তাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতাদের অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হতো।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির এক সদস্যের ভাষ্য, “বিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম প্রধান শিক্ষক একক সিদ্ধান্তে পরিচালনা করতেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।”
স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলা চেয়ারম্যান নুর হোসেন পাটওয়ারীর ডান হাত হিসেবে পরিচিত আব্দুল মান্নান বিভিন্ন সময় তার নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্বও পালন করেন। এমনকি উপজেলা চেয়ারম্যানের জন্য কলাম লেখা এবং বক্তব্যের খসড়া প্রস্তুত করার কাজও তিনিই করতেন।
*রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও ক্ষমতার দাপট*
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চাঁদপুরের পুরাণ বাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমারের মতোই আব্দুল মান্নান উপজেলা চেয়ারম্যান নুর হোসেন পাটওয়ারীর জন্য কাজ করেছেন। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। ২০২০ সালে নুর হোসেন দ্বিতীয়বার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে ছিলেন আব্দুল মান্নান।
সাবেক এক ছাত্র জানান, “আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবলে বিদ্যালয়ের সব সিদ্ধান্ত একক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হতো। বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের কোনো সুযোগ দেওয়া হতো না, বরং তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হতো।”
অভিযোগ রয়েছে, আব্দুল মান্নান উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রভাব খাটিয়ে হাইমচর প্রেসক্লাবের সদস্যপদও বাগিয়ে নেন, যদিও তিনি পেশাদার সাংবাদিক নন।
*দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ*
বিদ্যালয়ের জমিদাতা সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আ. রহিম তালুকদার অভিযোগ করেন, তার জমিতে অনুমতি ছাড়া একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া, বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষানুরাগী সদস্য হাসান ইমাম মাসুদ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
তাদের অভিযোগ অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান শিকদার শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম করেছেন এবং নিয়োগপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেছেন। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় থেকে তিনি প্রতি মাসে প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা নিজের জন্য রাখেন, অথচ অন্যান্য শিক্ষকদের মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে তিনি কমিশন নেন এবং সরকারি অনুদানের সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করেন না। বিদ্যালয়ের দুটি টিনের ঘর নিয়মবহির্ভূতভাবে বিক্রি করে প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, গত ১২ বছর ধরে তিনি এককভাবে ম্যানেজিং কমিটি নিয়ন্ত্রণ করছেন, যাতে অন্য কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি নিয়মিত ক্লাস না নিয়ে অনুপস্থিত থাকেন এবং কখনো কখনো হাজিরা খাতায় সই ছাড়াই অনুপস্থিতির দিনগুলো যোগ করে নেন।
বিদ্যালয়ের আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে, কারণ বিগত বারো বছর ধরে কোনো বার্ষিক অডিট হয়নি এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতি অসদাচরণের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়, বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয় এবং যারা এর বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান শিকদার বলেন, “আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা। নুর হোসেন পাটওয়ারীর সঙ্গে আমার কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ তুলছেন, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে এসব করছেন।”
তবে বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও স্থানীয়দের দাবি, তার কর্মকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত এবং প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
স্টাফ রিপোর্টার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫