জাতীয়

সড়ক নৌ ও আকাশ পথে বন্যপ্রাণী পাচার : মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে

বাংলাদেশ থেকে সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে পাচার হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচারকারীরাও রুট হিসেবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে পাচার হলেও কিংবা রুট হিসেবে এ দেশ ব্যবহৃত হলেও ধরা পড়ছে না পাচারকারী মূল হোতারা।

বন্যপ্রাণী পাচারের ওপর নজরদারি করা বেসরকারি সংস্থা ‘ট্রাফিক’ এর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে ‘আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচার চক্র বাংলাদেশকে রুট’ হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি।

এছাড়া ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশকে বন্যপ্রাণী পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালে রাজধানীর শ্যামলী থেকে দুইমাস বয়সী তিনটি বাঘের বাচ্চা উদ্ধার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর এবং ২০১৮ সালের ৮ মে যশোর থেকে ৯টি জেব্রা, দুটি সিংহ শাবক ও দুটি চিতা বাঘের শাবক উদ্ধার করা হয়। এছাড়া গত কয়েক বছরে অভিযান চালিয়ে বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে।

বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র বিভিন্ন দেশ থেকে আকাশ পথে বন্যপ্রাণী নিয়ে আসে বাংলাদেশে। সড়ক পথে এসব বন্যপ্রাণী চলে যায় দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকায়।

এরপর ভারত হয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশে তা পাচার করা হয়।

বনবিভাগের তথ্যমতে, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাচারের সময় প্রায় ৩২ হাজার বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে স্তন্যপায়ী ২৩৩টি, সরীসৃপ ৮০২১টি, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ২৩ হাজার এবং ট্রফি-৮৮২টি (ট্রফি হচ্ছে প্রক্রিয়াজাত করা বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ, যেমন বাঘের চামড়া, হরিণের মাংস, শিং বা চামড়া, হাতির দাঁত ইত্যাদি)।

তবে এর বাইরে যেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, সেগুলো পাচার হয়ে গেছে বিভিন্ন দেশে। পাচার করা বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি বলেই মনে করছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

বণ্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন সময় বণ্যপ্রাণী পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই চোরাচালানে একটি আন্তর্জাতিক চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। কখনও এই চক্র বাংলাদেশের ভেতর থেকে বিভিন্নভাবে বণ্যপ্রাণী পাচার করছে আবার কখনও তারা বাংলাদেশকে বণ্যপ্রাণী পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।

জানা যায়, বন্যপ্রাণী পাচারের ঘটনায় বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা সম্ভব হলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিংবা এর মূল হোতাদের আটক করা যায়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আটক করা সম্ভব হলেও তারা বন্যপ্রাণী বহনকারী মাত্র। তারাও আবার কিছুদিনের মধ্যেই জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। তবে মূল হোতা দেশি-বিদেশি চক্রটি সব সময়-ই রয়ে গেছে অধরা।

এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক অসীম মল্লিক বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বেনাপোল, হিলি এবং বাংলাবান্ধা পোর্ট দিয়েই বেশি জীবন্ত বন্যপ্রাণী এবং ট্রফি পাচার হয়। এছাড়া বর্তমানে আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা পোর্টগুলোতে সক্রিয় থাকার ফলে পাচারকারীরা রুট বদল করে পানি পথকে বেছে নিয়েছে। আমরা পানিপথের দিকেও গুরুত্ব সহকারে নজর রাখছি।

‘ট্রাফিক’-এর প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৫০০ কোটি টাকার বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ পাচার হয়। ২০১০ সালেও যার পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি টাকা। ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে ৫১টি বাঘের চামড়া হাড় এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করা হয়েছে।

বন্যপ্রাণী পাচার রোধে বনবিভাগের ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বনসংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, বন্যপ্রাণী বিষয়ে ক্রাইম এবং পাচাররোধে ২০১১ সালে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট গঠন করা হয়। তবে এ ইউনিটের লোকবল এবং লজিস্টিক সাপোর্ট অত্যন্ত সীমিত। ঢাকাকে কেন্দ্র করে আমাদের কার্যক্রম পরিচালিত।

‘ঢাকা ও আশেপাশে আমরা বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনে অভিযান পরিচালনা করে থাকি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের অভিযান পরিচালনা করার মতো সামর্থ্য নাই। ফলে সেখানে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন এবং পাচাররোধ করা সার্ভিকভাবে অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ে। এজন্য এই ইউনিটের লোকবল এবং লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি। এটি গৃহীত হলে, আমরা বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন এবং পাচার অনেকাংশেই রোধ করতে পারবো।’

বন্যপ্রাণী গবেষকরা বলছেন, এরই মধ্যে পরিবেশগত নানা বিপর্যয়ের কারণে দেশে অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাচারও হয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়ছে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিৎ বন্যপ্রাণী পাচার রোধে কঠোর আইনের প্রয়োগ করা।

পাশাপাশি বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার বিষয়েও গুরুত্ব দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানিয়েছেন তারা।

বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন রয়েছে। এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন এই আইনটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ভালো করে জানানো। বনবিভাগের পাশাপাশি বিভিন্ন পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক সংগঠন এই কাজটি করতে পারি আমরা। তাহলে এ বিষয়ে গণসচেতনা বাড়তে এবং বন্যপ্রাণী পাচার, হত্যা প্রভৃতি অপরাধ কমে আসবে।

বার্তা কক্ষ, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

Share