২৬ বছর আগে গাড়িচাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলায় দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর পরিবারকে ১ কোট ৬৯ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে গাড়ির মালিক বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
বুধবার (১৩ এপ্রিল) প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হুসেইন হায়দার।
আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মো. খলিলুর রহমান বলেন, টর্ট আইনের আওতায় এটিই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রথম রায়। চালকের ভুলে গাড়ির মালিককে অর্থদণ্ড দেয়ার রায় আমাদের দেশে এর আগে আর হয়নি। এ রায় দেশে আইনের শাসনের জন্য একটি মাইলফলক।
তিনি বলেন, এ রায়ের ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় কারো ক্ষতি করলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।
তিনি আরো বলেন, এর আগে ২০১৪ সালের ২০ জুলাই আপিল বিভাগ ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আপিল পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে রায় দেয়। ওই রায়ে আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতে দেয়া রায়ের আইনগত দিক বহাল রাখে।
তবে রায়ে বলা হয়, ক্ষতিপূরণ পুননির্ধারণ করবে আপিল বিভাগ। ‘দায়ী’ কোম্পানির আবেদন নিষ্পত্তি করে দিয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দেয়।
অ্যাডভোকেট খলিলুর রহমান বলেন, বিষয়টি পুনঃশুনানি শেষে আপিল বিভাগ ক্ষতিপূরণের অর্থ নির্ধারণ করে মামলাটি নিষ্পত্তি (ডিসপোজড অফ) করে গত বুধবার এই রায় ঘোষণা করেন।
নিহত সাংবাদিক মন্টুর সহধর্মিনী ও ক্ষতিপূরণের দাইবতে করা মামলার বাদী অধ্যাপিকা রওশন আক্তার বলেন, নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় এ মামলা পরিচালনা করে আসছি। এই দীর্ঘ সময়ের ধৈর্যের ফসল এ রায়।
তিনি বলেন, যানবাহন আইন ভঙ্গ করে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে তার স্বামীর জীবনহানির ঘটনায় তিনি ক্ষতিপূরণ চেয়ে দায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেছিলেন। এ জাতীয় ঘটনায় দেশের নাগরিকগণ এ রায়ে উপকৃত হবেন বলে তিনি মনে করেন।
ওই গাড়ির মালিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ১৯৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পণ্য পেপসিকোলার একটি মিনি ট্রাক রং সাইডে এসে কাকরাইলের আনন্দ ভবনের সামনে মোজাম্মেল হোসেন মন্টুকে চাপা দেয়। বাদশা মিয়া নামে কোম্পানির এক ড্রাইভার গাড়িটি চালাচ্ছিলেন।
এ ঘটনার পর ১৩ দিন অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন সাংবাদিক মন্টু। মন্টুর স্ত্রী রওশন আক্তার ক্ষতিপূরণ চেয়ে ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা তৃতীয় সাব জজ আদালতে মামলা করেন। ওই সময় নিম্ন আদালতে বিনা সম্মানিতে মামলাটি আইনজীবী হিসাবে দায়ের করেছিলেন দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত অ্যাডভোকেট আমিনুল হক।
সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ ও শুনানি শেষে ২০০৫ সালের ২০ মার্চ বিচারিক আদালত রায় দেয়। রায়ে নিহত সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়।
চালকের ভুলে কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া যায় না যুক্তি দেখিয়ে কোম্পানিটি হাইকোর্টে আপিল করে। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানকে নিয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১০ সালের ১১ মে রায় দেন। রায়ে চালকের ভুলে কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া যায় বলে মত দেয়ার পাশাপাশি টাকার পরিমাণ কমিয়ে ২ কোটি ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮ টাকা নির্ধারণ করেন। হাইকোর্টের ঘোষিত রায়ের বিরুদ্ধে কোম্পানির পক্ষ থেকে আপিল আবেদন করা হয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।
মোজাম্মেল হোসেন মণ্টু ১৯৪৫ সালের ১৫ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে সফল জীবনের অধিকারী মরহুম মন্টু ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর সাংবাদিকতা পেশাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি দৈনিক সংবাদে সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়ে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন।
১৯৮৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর মৃত্যুকালীন পর্যন্ত তিনি সংবাদের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।