জাতীয়

সৎ, নির্ভীক ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকের নাম আলতাফ মাহমুদ

আলতাফ মাহমুদ। এক সৎ, নির্ভীক ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকের নাম। স্বাধীনতার পর সাংবাদিকদের রুটি-রুজির আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে দীর্ঘদিন ধরেই নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তিনি। রোববার ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিএফইউজের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

১৯৫৪ সালে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ডাকুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সাংবাদিক নেতা আলতাফ মাহমুদ। স্থানীয় স্কুল ও কলেজে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই সংস্কৃতিমনা এই মানুষটির যেমন লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিল, তেমনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পদচারণা ছিল সমানতালে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্ম হয়। স্বাধীনতার আগ থেকে আলতাফ মাহমুদ বিভিন্ন সাময়িকীতে লেখালেখি এবং মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে থাকেন। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা এগারোজন’ এবং ‘কলমিলতা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন সুদর্শন আলতাফ মাহমুদ।

আলতাফ মাহমুদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী সিনিয়র সাংবাদিক স্বপন দাশ গুপ্ত বলেন, পটুয়াখালী থেকে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন নায়ক হওয়ার আশায়। তার ইচ্ছে ছিল ভালো অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্রের একজন নায়ক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করবেন। চলচ্চিত্র পরিচালক সরদার জাহাঙ্গীরের একটি ছবিতে (‘ফাঁসি’) নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। কিন্তু ওই চলচ্চিত্র মুক্তি না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তার সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়নি।

সহকর্মীদের মতে, আলতাফ মাহমুদ চলচ্চিত্রে নায়ক হতে না পারলেও সাংবাদিকদের ‘নায়ক’ হতে পেরেছিলেন ঠিকই। সততা, যোগ্যতা ও নিষ্ঠার কারণে মৃত্যুর পর সহকর্মীদের (সাংবাদিক) কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন মহানায়ক।

পাকিস্তান আমলে (শেষের দিকে) দৈনিক পয়গামে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি আলতাফ মাহমুদের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পয়গাম দৈনিক স্বদেশ নামে বাংলাদেশে প্রকাশ হতে থাকে। তিনি এই পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। এরপর দৈনিক কৃষাণ, সাপ্তাহিক খবর (পরবর্তীকালে দৈনিক) ও সর্বশেষ দৈনিক ডেসটিনিতে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন আলতাফ মাহমুদ।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকদের পেশার মান উন্নয়ন ও রুটি-রুজির আন্দোলনেও সারা জীবন সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রেখেছেন সামনের সারি থেকে। ১৯৭৬ সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) কার্যনির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন আলতাফ মাহমুদ। এরপর পর্যায়ক্রমে ডিইউজের কল্যাণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি, বিএফইউজের মহাসচিব ও সর্বশেষ সভাপতি ছিলেন তিনি।

ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিক হিসেবে সবার কাছেই তিনি ছিলেন জনপ্রিয় ব্যক্তি। ভোগবিলাস ও লোভ-লালসা কখনই তাকে পেয়ে বসেনি। আলতাফ মাহমুদের সমমানের অনেক সাংবাদিক নেতা এমনকি অনেক জুনিয়র নেতারাও দামি গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ান। অথচ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাসে ঝুলেই গন্তব্যে পৌঁছাতেন।

আলতাফ মাহমুদ দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক। ছেলে আসিফ মাহমুদ তপু বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় কর্মরত। বড় মেয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন। ইতোমধ্যে তার বিয়ের কাবিন হয়ে আছে। আগামী মে মাসে তার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার দিন ধার্য রয়েছে। ছোট মেয়েও একই ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত।

ছেলে আসিফ মাহমুদ তপু বলেন, ‘বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পটুয়াখালীতে তিনি যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তিনি কখনই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিতেন না।’

আলতাফ মাহমুদের শ্যালক মাকসুদ বলেন, ‘উনাকে (আলতাফ মাহমুদ) মুক্তিযোদ্ধার ভাতা নেওয়ার জন্য যখন বলতাম, তিনি বলতেন কী লাভ? আমারটা অন্যরাই নিক না।’

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ‘আলতাফ মাহমুদ সাংবাদিকদের আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন ধূমকেতু। ঢাকার সব আন্দোলনের পুরোধা ও নির্মোহ নেতা ছিলেন তিনি। আলতাফ ভাই এমন ব্যক্তি ছিলেন, যার ওপর সাংবাদিক সমাজের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা, ওয়েজ বোর্ডসহ সব আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। অনেক সময় অসুস্থতার মধ্যেও তিনি আন্দোলনে যোগ দিতেন।’

তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রের নায়ক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলতাফ ভাই ঢাকায় এসেছিলেন। একটি ছবিতে তিনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন। কিন্তু, তা মুক্তি পায়নি। তিনি ভালো গানও গাইতেন। উনার মতো যোগ্য নেতা বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতে আসবেন কবে তা বলা দুষ্কর। হঠাৎ তার মৃত্যু আমাদের জন্য খুবই অপ্রত্যাশিত।’

ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ বলেন, ‘আলতাফ ভাই সাংবাদিক সমাজের অত্যন্ত কাছের মানুষ ও জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি আমৃত্যু সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন। অগ্রভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এছাড়াও দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাংবাদিকদের নেতৃত্ব ছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘আলতাফ মাহমুদ সাংবাদিক সমাজের প্রাণ ছিলেন। তার মৃত্যুতে যে ক্ষতি হলো তা পূরণ হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।’
রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এবং দুপুর সোয়া ১২টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলতাফ মাহমুদের দুই দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা ছাড়াও মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘দেশ যখন ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের দিকে যাচ্ছে, তখন তার মতো একজন নির্ভীক সাংবাদিকের খুব প্রয়োজন ছিল। কারণ তিনি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সাংবাদিক ছিলেন।’

জাতীয় প্রেস ক্লাবে জানাজা-পরবর্তী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘উনি সারাজীবন সৎ সাংবাদিকতা করেছেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিক সমাজের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের গণতন্ত্র রক্ষা এবং পুনরুদ্ধারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কাজ করেছেন। এজন্য সাংবাদিক সমাজ তাকে স্মরণ করছে এবং করবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার ভোরে ইন্তেকাল করেন সাংবাদিক নেতা আলতাফ মাহমুদ। তার মেয়ে আইরিন মাহমুদ জানান, তার বাবাকে অস্ত্রোপচারের পর নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় শনিবার রাত ৩টার দিকে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। রবিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন। তবে, সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে মুখে থাকা লাইফ সাপোর্ট খুলে আলতাফ মাহমুদকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

গত ১৪ জানুয়ারি স্পাইনাল কডের (মেরুদণ্ডের হাড়) সমস্যা, মাথার পেছনে ও ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন প্রবীণ এ সাংবাদিক। এরপর ২১ জানুয়ারি সকালে তার স্পাইনাল কডের অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পরপরই আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট)-তে নেওয়া হয় তাকে। ২২ জানুয়ারি তার জ্ঞান ফেরে। পরে আবার তার অবস্থার অবনতি হলে আইসিউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই তিনি ভোরে ইন্তেকাল করেন।

ডিআরইউ ও জাতীয় প্রেসক্লাবে দুই দফা জানাজা শেষে আলতাফ মাহমুদকে রাজধানীর রামপুরার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে স্বজনদের দেখার জন্য বেশ কিছু সময় দেওয়া হয়। এরপর হেলিকপ্টারযোগে আলতাফ মাহমুদের মরদেহ পটুয়াখালীর গলাচিপায় নিয়ে যাওয়া হয়। সোমবার (২৫ জানুয়ারি ২০১৬) বেলা ১১টার মধ্যে গ্রামের বাড়িতে দাদা সুন্দর আলীর কবরের পাশে বাবাকে দাফন করা হয়েছে।

তথ্য : কাওসার আজম, দ্য রিপোর্ট

নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০১:১১ পিএম, ২৫ জানুয়ারি ২০১৬, সোমবার

এমআরআর  

Share